রম্যরচনায় সৈয়দ মুজতবা আলী

 

রম্যরচনায় সৈয়দ মুজতবা আলী

বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য প্রতিভা সৈয়দ মুজতবা আলী। পাণ্ডিত্য এবং রসবোধের এমন অপূর্ব মিশ্রণ খুব কম লোকের লেখনীর মধ্যেই দেখা যায়। সাধারণভাবে আমরা দেখি পণ্ডিত ব্যক্তিরা একটু রাশভারী বা গম্ভীর প্রকৃতির হয়ে থাকে কিন্তু সৈয়দ মুজতবা আলী যেন এর ব্যতিক্রম। তিনি যেমন তার পাণ্ডিত্য দিয়ে আমাদেরকে মুগ্ধ করেছেন তেমনি রসবোধের মধ্যে সেই পাণ্ডিত্য ঢেলে দিয়ে বাংলা সাহিত্যের রসবোধকে দিয়েছেন অন্য মাত্রা। 

সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্ম ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪ খ্রি: বতৃমান ভারতের করিমগঞ্জ জেলায়। পিতার নাম সৈয়দ সিকান্দার আলী। ব্রিটিশ সরকারের দেয়া উপাধি খান বাহাদুর। পৈত্রিক নিবাস ছিল হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার উত্তরসূর গ্রামে।

পিতার চাকুরির সুবাদে বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। সিলেট গভর্নমেন্ট স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করে ১৯২১ সালে বিশ্বভারতীতে ভর্তি হন। পড়াশুনা শেষ করে ১৯২৬ সালে থেকে  কাবুলে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষতা করতে যান। সেখান থেকে ১৯২৯-১৯৩২ সাল পর্যন্ত বৃত্তি নিয়ে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্রের উপর পড়াশুনা করতে যান। মিশরের কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৩৪-৩৫ সাল পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। 

এরপরে সৈয়দ মুজতবা আলী তার বর্ণিল কর্মজীবনে বারোদা কলেজের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক, বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন অধ্যাপনা, আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টর এবং সর্বশেষ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি স্টাডিজ বিভাগের রিডার হিসেবে ১৯৬৫ সালে কর্মজীবন সমাপ্ত করেন।

সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা বলতে গেলেই রম্যরচনার কথা উঠে আসে। আধুনিক যুগে রম্যরচনা বলতে আমরা লঘু কল্পনার সাহায্যে রচিত এক ধরনের হাস্যরসাত্মক রচনাকে বুঝি। তবে শুধু হাস্যরস পরিবেশন করলেই হবে না, রচনায় থাকতে হবে উইট তথা বুদ্ধিদীপ্ত ব্যঙ্গ কৌতুকধর্মীতার ঝাঁজালো রস। 

বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রধান পরিচয় রম্যলেখক হিসেবে। কিন্তু এটি একেবারেই ভুল। তিনি একাধারে লিখেছেন, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী, উপন্যাস, ছোটগল্প। যেমন তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ভ্রমণকাহিনীকার। ‘দেশে-বিদেশে’ গ্রন্থের মত ভ্রমণকাহিনী বাংলা সাহিত্যে এখনও হাতে গোনা। 

তবে এটা ঠিক যে, সৈয়দ মুজতবা আলীর সহজ, সরস, মজলিশি ভঙ্গিতে পরিবেশিত সব রচনাতেই রম্য উপাদানটির মিশেল দেয়া। এটি যেন তার সহজাত একটি প্রবণতা। এ প্রসঙ্গে সাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের উদ্ধৃতি স্মরণীয়-“ ইউরোপীয় সাহিত্যে স্যাটায়ার বা ব্যঙ্গসাহিত্যের প্রকাশ হয় প্রধানত দুই প্রকারে- এক জুভেনালের আদলে, যেখানে শাণিত, অনেক সময় ব্যক্তিগত আক্রমণই প্রধান হয়ে ওঠে। আরেক হলো হোরেসের পন্থায়, যেখানে রসবোধটাই প্রধান, হাসতে হাসতে সংশোধনটাই প্রধান। তিনি হোরেসের অনুসারী ছিলেন, হাসতেন মাথা দিয়ে, সূক্ষ্ম কৌতুকরসের সঞ্চার করে, নানান কিছুর মধ্যকার অসংগতিকে বেঢপ আকৃতিতে সাজিয়ে, শব্দের প্রাণিত-শাণিত খেলায় মেতে। কথার পিঠে কথা সাজানো ছিল তাঁর সহজাত একটি প্রতিভা। ইংরেজিতে যাকে ঢ়ঁহ বলে, সেটি ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক। 

সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখালেখিতে রম্য ও রসের যে উপস্থিতি, তা কখনো মাত্রাতিরিক্ত নয়। কোন কথায়, কতটা কথায়, কোন প্যাঁচে কে কতটা হাসবে এবং হাসতে হাসতে ভাববে, নিজেকে মাপবে, সেই রসায়ন তিনি জানতেন। তাঁর এই পরিমিতিবোধ ছিল অসামান্য। তিনি বলতেন, মোনালিসা যে এত অবিস্মরণীয় এক চিত্রকর্ম, তার পেছনে দা ভিঞ্চির আঁকিয়ে-হাতের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না তাঁর পরিমিতিবোধ। ব্রাশের একটা অতিরিক্ত সঞ্চালন ছবিটির রহস্য কেড়ে নিত। একজন রম্যলেখকেরও থাকতে হবে সেই জ্ঞান, তালে-ঠিক কোনো মদ্যপায়ীর মতো, ঝানু জুয়াড়ীর মতো। বাংলা সাহিত্যে মুজতবা আলীর পাকাপোক্ত স্থান রম্যলেখক হিসেবে।”

বাংলা সাহিত্যের যথার্থ ভদ্রলোক সৈয়দ মুজতবা আলী বহুভাষাবিদ এবং পণ্ডিত ছিলেন। পাণ্ডিত্য তার সাহিত্যিক রসবোধে এনে দিয়েছিল পরিমিতি বোধ। তিনি আমাদের হাস্যরস পরিবেশন করে কঠিন কথা বলতে বলতেও হাসিয়েছেন কিন্তু সেটা হালকা বা চটুল কোন বাক্য প্রয়োগ করে নয়। বুদ্ধিদীপ্ত সূক্ষ্ম রসবোধের উইট দিয়ে। রম্য লেখক হিসেবে এখানেই তিনি অনন্য, অন্যদের থেকে আলাদা। 

মহান এ লেখক ১৯৭৪ সালের এই দিনে ১১ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। 




 

   

বাংলা কথাসাহিত্যে ভাষা-আন্দোলন

সৌজন্যে: ইত্তেফাক


বাংলা কথাসাহিত্যে ভাষা-আন্দোলন

ভাষা-আন্দোলন বাঙালির জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ভাষার অধিকারের জন্য জনগণের এই অতুলনীয় সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ দেশবিভাগের পরই পূর্ববঙ্গে শুরু হয়। সাতচল্লিশের ডিসেম্বরে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে কেন্দ্রিয় পর্যায়ে শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণ পরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনে বাংলাকে অন্যান্য ভাষার সাথে অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের দাবি উত্থাপন করা হয়। কিন্তু তৎকালীন মুসলিম লীগের কিছু নেতা এ দাবির বিরোধীতা করেন। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবং ২৪ মার্চ কার্জন হলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে এবং জিন্নাহর ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ফলে সরকারের চূড়ান্ত দমননীতি নেমে আসে ছাত্রদের উপর। ছাত্র-জনতার দুর্বার শক্তির কাছে নাজিমুদ্দিন সরকার নতি স্বীকার করে। কিন্তু নাজিমুদ্দিন সরকার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। 

১৯৫২ সালের শুরুতেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আবার দানা বেঁধে ওঠে। ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন নির্লজ্জের মতো ঘোষণা করেন ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’ এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পূর্ণ ধর্মঘট ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসভা করে ও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠন করা হয়। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হবার পর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে প্রায় ৫ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর এক সুদীর্ঘ মিছিল বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। বিকালে কর্মপরিষদের জনসভায় মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম , অন্যান্য রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতারা সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার তীব্র নিন্দা করেন এবং বাংলা ভাষার দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম চালাবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। সেই দিনই, ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান দেওয়া হয়। 

২১ শে ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট বানচাল করার জন্য সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে মিছিল ও গণ জমায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিতে দিতে দশজন দশজন করে রাজপথে বেরিয়ে আসে। পুলিশ ছাত্রদের উপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করেলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও আরও অনেকে শহীদ হন। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের কথা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সমগ্র দেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আতঙ্কিত পাকিস্তান সরকার পরবর্তীতে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এভাবে সফল হয় ভাষা-আন্দোলন। 

মাতৃভাষার জন্য রক্ত দেয়ার ইতিহাস পৃথিবীতে ছিল না। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে রচিত দুর্লভ ইতিহাসের এ চেতনা জীবন্ত হয়ে আছে বাংলাদেশের সাহিত্যে। বাংলা সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই, যেখানে একুশের ছোঁয়া লাগেনি। গল্প, কবিতা, ছড়া, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, চলচ্চিত্র, সংগীত ইত্যাদি ক্ষেত্রে একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতি অমর হয়ে আছে। ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যে সাহিত্য রচিত হয়েছে এগুলোর মধ্যে আমরা অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, স্বদেশ ও মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ প্রভৃতি মূর্ত হতে দেখি। 

ভাষা-আন্দোলনের লেখক বোদ্ধাদের ভেতরে যাঁরা আছেন তারা হলেন আলী আশরাফ, শামসুর রাহমান,  জহির রায়হান, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, আব্দুল গণি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, শওকত ওসমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম, আতোয়ার রহমান, মুর্তজা বশীর, সালেহ আহম্মদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, তোফাজ্জল হোসেন, জসিম উদ্দিন, আব্দুল লতিফ, মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, আবু জাফর শামসুদ্দিন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শহীদুল্লাহ কায়সার, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুহ প্রমুখ লেখকের নাম উল্লেখযোগ্য।

বায়ান্নর চেতনাকে ধারণ করে আমাদের কথাশিল্পীরা নতুন ফসলের জন্ম দিয়েছেন। এ চেতনায় আছে জালিমের প্রতি ধিক্কার আর শহীদদের প্রতি মহান শ্রদ্ধা নিবেদন। একুশকে নিয়ে প্রথম উপন্যাস লেখেন জহির রায়হান আরেক ফাগুন (১৯৬৯) নামে। ১৯৫৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন করতে গিয়ে যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন আরেক ফাগুন তাদের কাহিনী। আরেক ফাগুন ছাড়াও শওকত ওসমানের আর্তনাদ, সেলিনা হোসেনের নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি ও যাপিত জীবন উপন্যাসের কথা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

সংখ্যার দিক থেকে উপন্যাসের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও বায়ান্নের ভাষা-আন্দোলনকে নিয়ে ছোটগল্প রচিত হয়েছে বেশ। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনে স্থান পেয়েছে পাঁচটি গল্প। এরপর ১৯৮৪ সালে রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় আরো একটি গল্প সংকলন পাওয়া যায় যাতে স্থান পেয়েছে বারোটি গল্প। এর মধ্যে আটটি নতুন গল্প বাকি চারটি একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন থেকে গৃহীত। ১৯৯১ সালে ফরিদ কবির সম্পাদিত একুশের গল্প সংকলনে মোট গল্প ছিল চৌদ্দটি। এর মধ্যে দশটি গল্প নেয়া হয় রশীদ হায়দার সম্পাদিত একুশের গল্প সংকলন থেকে ।১৯৯৯ সালে বাংলা একাডেমি থেকে হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, রশীদ হায়দার ও মোবারক হোসেন সম্পাদিত একুশের গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়। তাতে রয়েছে চুয়াল্লিশ জন লেখকের গল্প। 

একুশের যে চেতনা তা থেকে বাংলাদেশের কথাসাহিত্য পল্লবিত হয়েছে এবং অতীতের যোগসূত্রকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাইতো ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত কথাসাহিত্যে মানুষ এবং সময় তার সমগ্রতা নিয়ে উঠে এসেছে। শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন এ দেশের কথাশিল্পীরা যথাযথ দিতে চেষ্টা করেছেন। ভাষা-আন্দোলনকে ঘিরে সাহিত্যচর্চা গোটা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। কোন সাহিত্যিক এখন আর একুশের চেতনার বাইরে নয়। একুশ ছিল এদেশের প্রথম রক্তাক্ত প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদী চেতনারই প্রভাব বাংলাদেশের সাহিত্যকে উত্তরোত্তর এগিয়ে নিয়ে যাবে।



পল্লীকবি জসীমউদদীনের জীবন ও তার অনন্য সৃষ্টি


পল্লীকবি জসীমউদদীনের জীবন ও তার অনন্য সৃষ্টি


            আমার বাড়ি যাইও ভোমর/ বসতে দিব পিঁড়ে

            জল পান যে করতে দেব/ শালি ধানের চিঁড়ে। (আমার বাড়ি)

                                                অথবা

            এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে

            তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।  (কবর)

                                                কিংবা

            তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়

            গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;  (নিমন্ত্রণ)

এ ধরনের অসংখ্য স্নিগ্ধ পংক্তিমালার রচয়িতা যিনি তিনি আমাদের পল্লীকবি জসীমউদদীন। যিনি বাংলার পল্লীর জীবন এবং প্রকৃতিকেই তার সাহিত্য রচনার বিষয়বস্তু করেছিলেন। 

কবি জসীমউদদীনের জন্ম তার মাতুতালয়ে ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে, ১৯০৩ সালে ১ জানুয়ারি। পৈত্রিক নিবাস ফরিদপুরের গোবিন্দপুরে। ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর থেকে আইএ, বিএ ডিগ্রী সমাপ্ত করেন। এরপর ১৯৩১ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ ডিগ্রী লাভ করেন। স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে ডঃ দীনেশচন্দ্র সেনের আনুকূল্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পল্লীগীতি সংগ্রাহক হিসেবে রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে নিযুক্তি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে লেকচারার পদে যোগদান করেন। ১৯৪৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকারের পাবলিসিটি বিভাগে অফিসার পদে যোগ দেন।  ১৯৬২ সালে প্রচার বিভাগের ডেপুটি ডাইরেক্টর পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।  

বাংলা সাহিত্যে জসীমউদদীন একেবারেই স্বতন্ত্র স্বর এবং সুরের একজন লেখক। অত্যন্ত সহজ, সরল ভাষায় পল্লী বাংলার জীবন ও প্রকৃতির রূপকার হিসেবে তার কাছাকাছি আর কেউ নেই। তার কবিতায় নিসর্গের মুগ্ধ করা কোন বর্ণনা নেই, বিদ্রেহের সংগ্রামী অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নেই, নেই নবজাগরণের আহবান। আছে কেবল অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় আবহমান পল্লীর সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার নির্মোহ কথন। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও অন্যান্য সকল লেখকের মত তার লেখায় ছিল না নাগরিক যান্ত্রিক জীবনের ক্লেদাক্ত প্রকাশ। এমনকি পা-িত্য প্রকাশের জন্য শিল্পতত্ত্বে জর্জরিত অলংকার বহুল লেখনিও নেই। বরং জসীমউদদীনের লেখায় সরল পল্লী জীবনের নির্মেদ সহজ প্রকাশই আমাদের বেশি আকৃষ্ট করে। 

ছাত্র অবস্থাতেই ১৯২৫ সালে কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল কবির বিখ্যাত কবিতা ‘কবর’। প্রকাশিত হওয়ার পরেই কবিতাটি মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে পাঠপুস্তকে অর্ন্তভূক্ত হয়ে কবিকে বিরল সম্মান এনে দিয়েছিল। কবির প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘রাখালী’। প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয় তার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’। 

কবি যে সময়ে সাহিত্য চর্চা শুরু করেছিলেন সে সময়টা ছিল বাংলা সাহিত্যে কল্লোল যুগ। কল্লোল পত্রিকাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল কল্লোল সাহিত্য গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর সকল কবি লেখকই ছিলেন উগ্রভাবে পাশ্চাত্য আধুনিকতায় বিশ্বাসী। রবন্দ্রী প্রভাব থেকে মুক্তি খুঁজতে গিয়ে তারা ইউরোপের সাহিত্য আদর্শকে আকঁড়ে ধরেছিলেন।  বাংলা সাহিত্যে আমদানি করেছিলেন পাশ্চাত্য আদর্শ এবং আধুনিকতা। 

সাহিত্যে পাশ্চাত্য আধুনিকতার এই জোয়ারে জসীমউদদীন সম্পূর্ণ একাকী পল্লীর পথে হাঁটলেন। পাশ্চাত্য আধুনিকতার আদর্শে নাগরিক জীবনের ভাষ্যকার না হয়ে তিনি ফিরিয়ে আনলেন কাহিনীকাব্যের ঐতিহ্যগত ধারাকে। লিখলেন ‘নক্সী কাঁথারা মাঠ’, ‘সোজন বাদীয়ার ঘাট’, ‘মা যে জননী কান্দে’ এর মত কাহিনীকাব্য। পাশ্চাত্য দোলাচলে বাঙালি সংস্কৃতি যখন হারিয়ে যাচ্ছে সেই সময়ে জসীমউদদীনের সৃষ্টিকর্ম আবার বাংলার সেই চিরচেনা রূপটি ফিরিয়ে দিয়েছিল। তিনি আরেক বার বাঙালি পাঠককে মুগ্ধ করেছিলেন। ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থটি ই এম মিলফোর্ড কর্তৃক অনুদিত হয়ে The Field Of Embroidered Quilt নামে ইংরেজিতে প্রকাশিত হলে কবিকে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এনে দিয়েছিল। এছাড়াও লিখেছেন 

কাব্যগ্রন্থ:

রাখালী (১৯২৭)

নক্সী  কাঁথার মাঠ (১৯২৯)

বালুচর ( ১৯৩০)

ধানক্ষেত ( ১৯৩৩)

সোজন বাদিয়ার ঘাট ( ১৯৩৪)

হাসু ( ১৯৩৮)

রূপবতী ( ১৯৪৬)

মাটির কান্না ( ১৯৫১)

এক পয়সার বাঁশী ( ১৯৫৬)

সকিনা ( ১৯৫৯)

সুচয়নী ( ১৯৬১)

ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৬২)

মা যে জননী কান্দে ( ১৯৬৩)

হলুদ বরণী  ( ১৯৬৬)

জলে লেখন (১৯৬৯)

পদ্ম নদীর দেশে (১৯৬৯)

মাগো জ্বালায়ে রাখিস আলো (১৯৭৬)

কাফনের মিছিল (১৯৭৮)

মহরম

দু মুখো চাঁদ পাহাড়ী (১৯৮৭)

নাটক:

পদ্মাপার ( ১৯৫০)

বেদের মেয়ে ( ১৯৫২)

মধুমালা ( ১৯৫১)

পল্লীবধূ (১৯৫৬)

গ্রামের মেয়ে (১৯৫৯)

ওগো পুষ্পধনু (১৯৬৮)

আসমান সিংহ (১৯৮৬)

ভ্রমণকাহিনী :

চলে মুসাফির (১৯৫২)

হলদে পরীর দেশে (১৯৬৭)

যে দেশে মানুষ বড় (১৯৬৮)

জার্মানীর শহরে বন্দরে (১৯৭৫)

কথাশিল্পী হিসেবেও তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। যেমন- 

বাঙালীর হাসির গল্প (১ম খণ্ড-১৯৬০) (২য খণ্ড-১৯৬৪)

ডালিম কুমার (১৯৮৬)

উপন্যাস :

বোবা কাহিনী (১৯৬৪)

আত্মজীবনী :

যাদের দেখেছি (১৯৫১)

ঠাকুর বাড়ির আঙিনা (১৯৬১)

জীবন কথা (১৯৬৪)

স্মৃতিপট (১৯৬৪)

স্মরণের সরণী বাহি (১৯৭৮)

সঙ্গীত:

রঙিলা নায়ের মাঝি ( ১৯৩৫)

গাঙের পাড় (১৯৬৪)

জারি গান (১৯৬৮)

মুর্শিদী গান (১৯৭৭)

সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি অনেকগুলো পুরস্কার লাভ করেছিলেন। যেমন-

১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্টস এওয়ার্ড ফর  প্রাইড অফ পারফরশ্রান্স (পাকিস্তান )

 ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট ডিগ্রি, (ভারত)

১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার (বাংলাদেশ- প্রত্যাখ্যান)

১৯৭৬ সালে একুশে পদক (বাংলাদেশ)  

১৯৭৮ স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (বাংলাদেশ-মরণোত্তর)

মূলত আধুনিক মননের অধিকারী পল্লী জীবন ও প্রকৃতির সহজ সরল রূপকার হিসেবে জসীমউদদীন সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবেন। তিনি ১৯৭৬ সালে ১৩ মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।  


সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীঃ জীবন ও কর্ম

 

সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীঃ জীবন ও কর্ম   

বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের শুরুতে যে সব মুসলিম সাহিত্যিক ইসলামী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কবিতা রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একাধারে সাহিত্যিক এবং রাজনীতিবিদ। লিখেছেন কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং ভ্রমণ-কাহিনী পাশাপাশি একজন সক্রিয় রাজনীতিবিদ হিসেবে করে গেছেন রাজনীতি। এই বরণ্য কবি এবং রাজনীতিবিদ জন্ম গ্রহণ করেন ১৩ জুলাই ১৮৮০ সালে তৎকালীন পাবনা জেলায়, বর্তমানে সিরাজগঞ্জে। সিরাজী ছিল তাঁর পারিবারিক ধর্মীয় পদবী। 

অভাবের কারণে উচ্চ শিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত হলেও নিজের চেষ্টায় তিনি সাহিত্য-ইতিহাস-ধর্মনীতি-সমাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। বিশ শতকের শুরুতে ভারতীয় কংগ্রেসে যোগদান করে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে মুসলীম লীগে যোগদান করেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দেদালনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।  বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষাবাংলা কিনা এই বিতর্কে তিনি বাংলা ভাষার পক্ষে দৃঢ় মত প্রকাশ করেছিলেন। 

১৮৯৯ সালে ‘অনল প্রবাহ’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী মনোভাব প্রকাশ পেলে ইংরেজ সরকার এই কাব্যগ্রন্থটি নিষিদ্ধ ঘোষনা করে এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে কবি এক পর্যায়ে দুই বছরের জন্য কারারুদ্ধ হন।   

বলকান যুদ্ধে তুরস্ককে সাহায্য করার জন্য ভারতবর্ষ থেকে ১৯১২ সালে যে মেডিকেল টিম প্রেরণ করা হয়েছিল তিনি ছিলেন সেই টিমের একজন সদস্য। সেখানে যুদ্ধে আহত সৈনিকদের সেবার অবদান স্বরূপ তুরস্কের সুলতান কর্তৃক গাজী উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। 

খিলাফত আন্দোলন এবং ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ সালে সংঘটিত অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। 

১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে স্বরাজ্যদল গঠিত হলে তাতে যেগদান করেন।

তিনি নূর নামে একটি মাসিক এবং সুলতান নামেও একটি সাপ্তাহিত পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।

সাহিত্যিক হিসেবে তিনি ছিলেন মূলত ইসলামী পুনর্জাগরণবাদী লেখক। তিনি ভারতবর্ষে হীনবল ইসলামের পুনর্জাগরণ চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্য নিয়েই ধারন করেছিলেন লেখনি। মুসলমানদের নবজাগরণ এবং দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা অর্জন ছিল তার জীবনের লক্ষ্য। এ কারণেই জাতীয় জাগরণ মূলক কাব্য সৃষ্টিতে ছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত এবং নজরুলের পূর্বসূরি। ভারতবর্ষে মুসলমানদের অন্ধকার কালে তাঁর কাব্য এবং অনলবর্ষী বক্তৃতা মুসলিম জাতিকে যেমন অনুপ্রাণিত করেছিল তেমনি আলোর পথও দেখিয়েছিল। সাড়া জেগেছিল বাঙালী মুসলমানের প্রাণে।

কাব্যগ্রন্থ

১) অনল প্রবাহ (১৯০০)

২) উচ্ছ্বাস (১৯০৭)

৩) উদ্বোধন (১৯০৭)

৪) নব উদ্দীপনা

৫) স্পেন বিজয় কাব্য (১৯১৪)

৬) মহাশিক্ষা

উপন্যাস

১) তারাবাঈ (১৯০৮)

২) রায়নন্দিনী (১৯১৬) 

৩) নূর উদ্দীন (১৯২৩)

৪) ফিরোজা বেগম (১৯২৩)

৫) জাহানারা (১৯৩১)

সঙ্গীত

১) সঙ্গীত সঞ্জীবনী (১৯১৬)

২) প্রেমাঞ্জলি (১৯১৬)

প্রবন্ধ

১) স্বজাতি প্রেম (১৯০৯) 

২) তুর্কি নারী জীবন (১৯১৩)

৩) আদব কায়দা শিক্ষা (১৯১৪)

৪) স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা (১৯১৬)

৫) সুচিন্তা (১৯১৬)

৬) মহানগরী কর্ডোভা

ভ্রমণ কাহিনী

১) তুরস্ক ভ্রমণ (১৯১০)

বজ্রকণ্ঠের এই কবি ১৯৩১ সালের ১৭ জুলাই ৫১ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। 




কায়কোবাদ ও তার কাব্যপ্রতিভা

কায়কোবাদ ও তার কাব্যপ্রতিভা

বাংলা মহাকাব্যের ধারায় উল্লেখযোগ্য প্রতিভা কবি কায়কোবাদ। কবির আসল নাম মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী হলেও সাহিত্য ক্ষেত্রে তিনি কায়কোবাদ নামে পরিচিত। কবির জন্ম ঢাকা জেলায় ১৮৫৮ খ্রীস্টাব্দে। খুব বেশি পড়ালেখা তিনি করতে পারেননি। নিজ এলাকাতেই ডাক বিভাগে সামান্য বেতনের চাকুরী করে জীবন অতিবাহিত করেন। 

মহাকবি হিসেবে পরিচিত হলেও মূলত গীতি কবিতা রচনার মধ্য দিয়েই সাহিত্য-ক্ষেত্রে কবির পদার্পণ। একেবারে কিশোর বয়সে বিরহ বিলাস (১৮৭০) এবং কুসুম কানন (১৮৭৩) রচনা করেন। তবে অশ্রুমালা (১৮৯৪) লিখেই মূলত তিনি সাহিত্যিক হিসেবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। 

তিনি মনে করতেন মহাকাব্য রচনা করতে পারাতেই প্রকৃত কবির পরিচয়। মহাশ্মশান কাব্যের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন-

“সাহিত্যের বাজারে আজকাল কবিতার বড়ই ছড়াছড়ি। কিন্তু দুঃখের বিষয় বঙ্গ-সাহিত্যে মহাকাব্যের জন্ম অতি বিরল। মধুসূদনের পর হইতে আজ পর্যন্ত মহাকবি নবীনচন্দ্র ও হেমচন্দ্র ব্যতীত কয়জন কবি মহাকাব্য লিখিয়াছেন। এখনকার কবিগণ কেবল ‘নদীর জল’ ‘আকাশের তারা’ ফুলের হাসি ও প্রিয়তমার কটাক্ষ লইয়াই পাগল। প্রেমের ললিত ঝংকারে তাহাদের কর্ণ এরূপ বধির যে, অস্ত্রের ঝনঝনি বীরবৃন্দের ভীষণ হুংকার তাহাদিগের কর্ণে প্রবেশ করিতে অবসর পায় না। তাহারা কেবল প্রেমপূর্ণ খণ্ড কবিতা লিখিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেন।” 

মহাকাব্যের মধ্যে কবি প্রতিভার সম্যক বিকাশ সম্ভব মনে করে তিনি গীতি কবিতাকে কোন গুরুত্ব দিতে চাননি। তাইতো তিনি গীতিকবিতার স্বর্ণযুগে মহাকাব্য লেখার প্রয়াস পেয়েছিলেন। 

১৯০৪ খ্রীস্টাব্দে তিন খণ্ডে সমাপ্ত তার বিশাল মহাকাব্য মহাশ্মশান প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি তিনি দশ বছর ধরে লিখেছিলেন। গ্রন্থটি ষাট সর্গে ৮৭০ পৃষ্ঠা নিয়ে লেখা হয়। 

১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠাদের পরাজয় এবং আহমদ শাহ আবদালীর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীর বিজয় বর্ণনা কাব্যটির বিষয়বস্তু। এ যুদ্ধে মারাঠাদের পরাজয় এবং মুসলিম বাহিনী জয়লাভ করলেও হিন্দু-মুসলমান উভয় জাতির জীবনে যে করুন এবং মর্মান্তি পরিনতি নেমে আসে কায়কোবাদ সেটাই তুলে ধরেছেন। কবির মতে-

“একপক্ষে পানিপথ যেমন হিন্দু গৌরবের সমাধিক্ষেত্র অপর পক্ষে সেইরূপ মুসলিম গৌরবেরও মহাশ্মশান।”

ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের পরে বাংলা সাহিত্যে জাতীয়তাবোধের যে প্রেরণা জেগে উঠেছিল কায়কোবাদ তারই অনুসারি ছিলেন। ওই সময়ে বাংলা সাহিত্যে মুসলিম লেখকদের সংখ্যা ছিল অতি নগন্য। ফলে মুসলমানদের গৌরবগাঁথা কোথাও লেখা হয়নি। তারই অভাববোধ থেকে কায়কোবাদ লেখনি ধারণ করেছিলেন। 

ইসলামি জাতীয়তাবোধের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হলেও কবি কায়কোবাদের ক্ষেত্রে এটি উল্লেখযোগ্য যে, তিনি অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছিলেন। হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির মধ্যেই এদেশের কল্যাণ নিহিত বলে তিনি মনে করতেন। তাইতো তার কণ্ঠে হিন্দু-মুসলমানের মিলনবাণী ঘোষিত হয়েছে।  

                এস ভাই এস হিন্দু মুসলমান

                একস্বরে আজি গাহিব এ গান;

                আমরা দুভাই ভারত সন্তান

                দুঃখিনি ভারত মোদের মাতা।

মহাশ্মশান কাব্যের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন-

“মুসলমানগণ বীরপুরুষ, হিন্দুগণও বীরপুরুষ, এই দুই বীরজাতি হৃদয়ের উষ্ণ শোণিতে আপনাদিগের জাতীয় গৌরব ও ভীষণ বীরত্ব কালের অক্ষয়পটে লিখিয়া গিয়াছেন।------- একজাতি দেশের জন্য, ধর্মের জন্য, স্বজাতির কল্যাণের জন্য হৃদয়ের পবিত্র শোণিতে স্বদেশ প্লাবিত করিয়া বিজয় গৌরবে গৌরবান্বিত হইয়াছেন। কম কে? উভয় জাতির বীরত্বই প্রশংসার্হ। ”

কায়কোবাদের এই অসাম্প্রদায়িক মনোভাব তার কাব্যকে বিশিষ্ট করেছ। 

একথা সত্য যে, কায়কোবাদ মহাকাব্য রচনায় শিল্পগত উৎকর্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি।  

অসংখ্য কাহিনী এতে স্থান পেয়েছে কিন্তু কাহিনীগুলো যেন বিচ্ছিন্ন। কাব্যে নায়কোচিত কোন চরিত্র নেই। আহম্মদ শাহ আবদালী, নজীবউদ্দৌলা, সুজাউদ্দোলা প্রভৃতি চরিত্রের মধ্যে নায়কোচিত পূর্ণতা নেই। মহাকাব্যের চরিত্র হিসেবে তারা দুর্বল। কাহিনী আকস্মিকতায় পরিপূর্ণ। কায়কোবাদের গীতিধর্মী গদ্যাত্মক সরল ভাষা মহাকাব্যের গাম্ভীর্য হারিয়েছে। 

ডঃ আনিসুজ্জামানের মতে-

‘মহাকাব্যের গাম্ভীর্য এতে নেই, কবির রোমান্টিক প্রবণতা অনাবশ্যক প্রেমকাহিনী সন্নিবেশের কারণ। সংলাপ দুর্বল, বর্ণনা পুনরুক্তি দোষে আক্রান্ত।’

সাহিত্য সমাজে কায়কোববাদের যে স্বীকৃতি সম্পূর্ণ রূপে তা তার শিল্পদক্ষতার জন্য না হলেও মুসলিম সমাজে তা আবেগ-আপ্লুত। বৃহদায়তনের মহাশ্মশান মহাকাব্য এবং তাতে মুসলিম গৌরবের ইতিহাসের প্রচার ও স্বজাত্যবোধের যুগোপযোগী চেতনা তাকে মর্যাদার এই আসনে বসিয়েছে। শিল্পের বিচার নাও যদি করা হয় তবু একথা বলা যায় যে, তিনি যে জাতীয়তাবোধের চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করে বৃহৎ একটা মহাকাব্য দিয়েছেন তা বাংলা সাহিত্যে অবশ্যই নতুন দান। এখানেই তার প্রতিভার সার্থকতা। 






মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ


 মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ

বাংলা সাহিত্যে অন্যতম প্রধান কবি ফররুখ আহমদ মুসলিম রেনেসাঁর কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত। তিনি এমন এক সময়ে জন্মেছিলেন যখন ভারতবর্ষের মুসলিম সমাজ চরম এক দুরবস্থার মধ্যে নিমজ্জিত ছিল। ধর্ম-রাজনীতি-শিক্ষা-বিজ্ঞান তথা প্রগতির বিপরীতি দিকেই ছিল তার গতি। সময়ের এই ক্রান্তি লগ্নে কবি ফররুখ আহমদ তার লেখনির মাধ্যমে চেষ্টা করেছিলেন পতনরত বাঙালি মুসলিম সমাজকে তার অতীতের সমৃদ্ধ সোনালি ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে আলোর পথে নিয়ে আসতে, প্রগতির পথে নিয়ে আসতে। যাতে তারা আবার তাদের সেই অতীতের হৃত গৌরব ফিরে পায়। তার কবিতার ভাব-বিষয়বস্তু অধঃপতিত মুসলিম সমাজকে পুনঃজাগরণের প্রেরণা জুগিয়েছে। 

কবি ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরা জেলার মাঝাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ হাতেম আলী। মাতা বেগম রওশন আক্তার। গ্রামের পাঠশালাতে শিক্ষাজীবনের হাতে খড়ি।

পরবর্তীতে কলকাতায় গিয়ে তালতলা মডেল এম.ই স্কুলে ভর্তি হন। এখান থেকে কলকাতার বিখ্যাত বালিগঞ্জ সরকারি হাই স্কুলে ভর্তি হন। ওই সময়ে কবি গোলাম মোস্তফা ছিলেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। প্রাথমিক জীবনে কবিত্ব বিকাশে কবি গোলাম মোস্তফা ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করেন।

১৯৩৭ সালে খুলনা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৯ সালে কলকাতার রিপন কলেজ হতে আই.এ পাশ করেন। ১৯৪১ সালে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন ও পরে কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বি.এ-তে ভর্তি হন। নানাবিধ কারণে পড়াশোনা আর শেষ করতে পারেননি। ১৯৪৩ সালে আই.জি প্রিজন অফিসে চাকরির মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইয়ে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি মাসিক “মোহাম্মদী” পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৪৮ সালে কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। ঢাকা বেতারে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ঢাকা বেতারে তিনি ‘ছোটদের খেলাঘর’ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। কবি প্রথম যৌবনে ভারতবর্ষের বিখ্যাত কমরেড এম.এন রায়ের শিষ্য ছিলেন। কিন্তু ইসলামী আদর্শ ও ঐতিহ্যের অধিকারী কবি একসময় ধর্মীয় চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে পড়েন এবং তাঁর কবিতায় ইসলামের অতীত গৌরব মূর্ত হয়ে ওঠে।

কবি হিসাবে তিনি ছিলেন মানবতাবাদী। কবিতা ছিল মানবতাবাদী দর্শনে পরিপূর্ণ। নীতি-আদর্শের প্রশ্নে ছিলেন আপোষহীন কিন্তু কাব্যে রসবোধ কমতি ছিল না। সাহিত্য সাধনার দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় তিনি আত্মবিমুখ হননি বরং তাঁর কাব্য ও রচনায় ‘বাঙালি মুসলিম’ পরিচয়টি জাগিয়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন বারংবার। তিনি লিখেছেন-

                    রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

                    এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?

                    সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?

                    তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;

                    অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।

                    রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

কবি ফররুখ আহমদের অন্যতম বড় একটি পরিচয় তিনি ছিলেন একজন ভাষা সৈনিক। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু হলে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন এবং বাঙালির অধিকারের পক্ষে কলম ধরেন‌।

তিনি বলেন- 

‘এটা দৃঢ়ভাবেই আশা করা যায় যে পাকিস্তানের জনগণের বৃহৎ অংশের মতানুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচিত হবে । যদি তা-ই হয়, তাহলে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে বাংলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে’। 

তিনি পাকিস্তানি শাসকদের সমালোচনা করে ‘রাজ-রাজরা’ নামে নাটক রচনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাটকটি মঞ্চায়িত হয়। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তার ‘মধুর চেয়েও মধুর যে ভাই আমার দেশের ভাষা’ গানটি তৎকালে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। কবি ফররুখ আহমদকে চরম দারিদ্র্যের সাথে জীবনযাপন করতে হয়েছে। কিন্তু অর্থের প্রতি ক্ষমতার প্রতি তার কোন মোহ ছিল না। দারিদ্রতাকে তিনি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। ভোগ বিলাসিতা তিনি ঘৃণা করতেন। মুসলিম কবিদের মধ্যে কাব্যনাটক রচনার পথিকৃৎ তিনি। তার ‘নৌফেল ও হাতেম’ একটি সফল ও জনপ্রিয় কাব্যনাটক। সনেট রচনায়ও তিনি সফল। শিশু সাহিত্য, প্রবন্ধ, নাটক, অনুবাদ সাহিত্যেও তার অবদান উল্লেখযোগ্য।

তার প্রথম এবং সেরা কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়া সিরাজাম মুনিরা, নৌফেল ও হাতেম, মুহূর্তের কবিতা, হাতেমতায়ী, পাখির বাসা, হরফের ছড়া, ছড়ার আসর, হে বন্য স্বপ্নেরা, ইকবালের নির্বাচিত কবিতা, চিড়িয়াখানা, কাফেলা, সিন্দাবাদ, কিচ্ছা কাহিনী, ফুলের জলসা, মাহফিল, ফররুক আহমেদের গল্প, ঐতিহাসিক অনৈতিহাসিক কাব্য, দিলরুবা প্রভৃতি তার অমর সাহিত্যকীর্তি। 

মহান এ কবি ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।






আলাওলের কাব্যপ্রতিভা এবং বাংলা সাহিত্যে তার অবদান


 আলাওলের কাব্যপ্রতিভা এবং বাংলা সাহিত্যে তার অবদান

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আলাওল। আনুমানিক ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে কবির জন্ম। কবির জন্মস্থান নিয়ে দুটি মত চালু আছে। কারও মতে বর্তমান ফরিদপুর জেলার ফতেয়াবাদ পরগনার  জালালপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কারও মতে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদের জোবরা গ্রামে কবির জন্ম। অভিজাত পরিবারের সন্তান আলাওল অল্প বয়সেই ভাগ্যদোষে দেশ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। বাবার সাথে নৌকায় করে যাওয়ার সময় পর্তুগীজ জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আরাকানে নীত হন। আরাকানে তিনি একজন সৈনিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও পরে নৃত্য-গীত এবং সঙ্গীত শিক্ষকের কাজ করেন। তার এ প্রতিভা অল্প দিনেই ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি একজন সঙ্গীতবিদ এবং গায়ক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। এই খ্যাতি তাকে আরাকান রাজসভার অমাত্য মহলে স্থান করে নিতে সাহায্য করে, তিনি কোরেশী মাগন ঠাকুর, সৈয়দ মুসা, সোলায়মান, মুহম্মদ খান, মজলিশ এ কুতুবের মত আরাকান রাজ অমাত্যগণের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। তাদের উৎসাহেই আলাওল একে একে রচনা করেন পদ্মাবতী, সতীময়না ও লোর চন্দ্রানী, সপ্তপয়কর, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল, সিকান্দার নামা, তোহফা এবং সঙ্গীত বিষয়ক রচনা রাগতালনামা। এছাড়াও বৈষ্ণবপদ মূলক কিছু গীতিকবিতাও তিনি রচনা করেন। 

মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভা বিদ্যাপতি, মুকুন্দরাম, চন্ডিদাস, জ্ঞানদাস, ভারতচন্দ্র এদের সাথে উচ্চারিত হয় আলাওলের নাম। আলাওলের অধিকাংশ রচনা অনুবাদ বলে অনেকে কবিকে অনুবাদের কবি বলতে চেয়েছেন। কিন্তু কোন উন প্রতিভার কবির পক্ষেই এত বিপুুল পরিমাণ রচনার অধিকারী হওয়া অন্তত মধ্যযুগে সম্ভব হয়নি। তাছাড়া আলাওল যে যথার্থই উজ্জ্বল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তা তার জীবনী এবং রচনাবলী থেকেই জানা যায়। তিনি বাল্যকালেই বাংলা, সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। ব্রজবুলি ও মঘী ভাষাও তার আয়ত্তে ছিল। 

ডঃ মুহ. এনামুল হক আলাওলকে মহাকবি বলেছেন। এ প্রশংসা আলাওলের প্রাপ্য এবং তা অতিরঞ্জন নয়। আলাওলের সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা ‘পদ্মাবতী’। কাব্যটি পরিণত কবিত্বকলার অনুপম সৃষ্টি। এটি হিন্দি কবি মালিক মুহম্মদ জায়সির পদুমাবৎ কাব্যের অনুবাদ হলেও আলাওলের পদ্মাবতী জায়সির পদুমাবৎ থেকে অনেকটা দূরে। এতে রূপক, আধ্যাত্মিকতা কেউ খুঁজলে খুঁজতে পারেন; কিন্তু সেই মরমি বৈশিষ্ট্যের চেয়ে এ কাব্যে মানুষের কাহিনিই মুখ্য। জায়সির অনেক অংশই পরিত্যক্ত, আধ্যাত্মিক অংশগুলো তো বটেই। নিজের সংযোজনা আছে মাঝেমধ্যে। এতে বোঝা যায়, মূল কাব্যের সীমার মধ্যে নতুন কিছু করার প্রয়াস আলাওলের বরাবরই ছিল। ‘পদ্মাবতী’র সাহিত্যমূল্য বিচার করতে গিয়ে দীনেশচন্দ্রসেন লিখেছেন-

“পদ্মবতী’ কাব্যে আলাওলের গভীর পাণ্ডিকত্যর পরিচয় আছে। কবি পিঙ্গলাচার্যের মগন, রগন প্রকৃতি অষ্ট মহাযানের তত্ত্ব বিচার করিয়াছেন, খণ্ডিতা, বাসকসজ্জা ও কলহান্তরিকা প্রভৃতি অষ্ট নায়িকার ভেদ বিরহের দশ অবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনা করিয়াছেন, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র লইয়া উচ্চাঙ্গের কবিরাজী কথা শুনাইয়াছেন, জ্যোতিষ শাস্ত্র সম্পর্ক লগ্নাচার্যের ন্যায় যাত্রার শুভাশুভের এবং যোগিনী চক্রের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করিয়াছেন।”


পদুমাবৎ-এ সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির রাজপুত রানি পদ্মিনীর রূপ-লাবণ্যে আকৃষ্ট হয়ে এবং রানিকে পাওয়ার জন্য অভিযান করলে রানি সহচরীদের নিয়ে জহরব্রত করেছিলেন। এই কল্পিত আখ্যানটি পদ্মাবতী কাব্যের মূল প্রসঙ্গ নয়, বরং রত্নসেন-পদ্মাবতীর প্রণয় কাহিনিই মুখ্য। জায়সির কাব্য আধ্যাত্মিক রূপক, সুফি-মরমী চেতনার উদ্বোধক। আলাওল এই কাহিনিকে মানবিক রসদৃষ্টি সম্পন্ন করেছেন। নায়িকার নামেই কাব্য, রোমান্স কাব্য, যেখানে আছে রূপবান অভিজাত নায়ক আর অনিন্দ্যসুন্দরী নায়িকা, যার রূপ বর্ণনায় আলাওল তার বইয়ের বেশ কয়েক পৃষ্ঠাই খরচ করেছেন; তাতে উপমার ছডাছড়ি বর্ণনাকে কত বর্ণাঢ্য করা যায়, তার তুলনাহীন কবিকৃতি। নায়িকার বর্ণনায় ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে চমৎকারভাবে ফারসি রীতিরও মিল ঘটাতে পেরেছেন স্বচ্ছন্দে। তীব্র প্রণয়ের সঙ্গে অভিযান, যুদ্ধবিগ্রহ, সংঘর্ষ, হিংসা-বিদ্বেষ, ষড়যন্ত্র সবই আছে, উপভোগ্যভাবেই আছে। এই কথা কেবল পদ্মাবতী নয়, রূপকথাশ্রয়ী অনুবাদ রচনা সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল এবং বীরকাহিনি সিকান্দারনামা সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। 

বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ পর্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠকবি আলাওল। মধ্যযুগে যে বাংলা সাহিত্য দেবদেবী এবং তত্ত্ব নির্ভর রচনা ছিল আলাওল সেখানে পরিপূর্ণ মানবিক। মানবিকতার জয় ঘোষনা এবং রোমান্স কাব্যেও ধারাকে পরিপুষ্টি সাধন বাংলা সাহিত্যে আলাওলের অন্যতম অবদান। একথা অনস্বীকার্য যে মধ্যযুগের বাঙালি কবি আলাওলের কাব্যসামগ্রী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চিরায়ত সম্পদ।


প্রতিভাবান এই মহাকবি আনুমানিক ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।






ডঃ মুহম্মদ এনামুল হকের জীবন ও কর্ম



ডঃ মুহম্মদ এনামুল হকের জীবন ও কর্ম

ডঃ মুহম্মদ এনামুল হক বাংলা ভাষা ও সাহিত্য গবেষণায় অন্যতম প্রধান পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি একাধারে গবেষক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। ১৯০২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বর্তমান চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার বখতপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মওলানা আমিনউল্লাহ। 

স্কুলে পড়াশুনা শুরু করার আগেই এনামুল হক বাংলা, আরবি, উর্দু ও ফারসি ভাষা শেখেন। রাউজান হাই স্কুলে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি  ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সংস্পর্শে আসেন এবং জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হন। এখান থেকেই তিনি ১৯২৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন এবং মোহসীন বৃত্তি লাভ করেন। তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ১৯২৫ সালে এফ.এ, ১৯২৭ সালে আরবিতে অনার্সসহ বি.এ এবং ১৯২৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাচ্যদেশীয় ভাষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এম.এ পাস করেন। এই কৃতিত্বের জন্য তিনি জগত্তারিণী স্বর্ণপদক লাভ করেন।

১৯২৯ হতে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি পেয়ে এনামুল হক অধ্যাপক সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের অধীনে গবেষণা করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল Ô History of Sufism in Bengal Õ। ১৯৩৫ সালে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবনের শুরুতে সামান্য বেতনে Writers Building-এ অনুবাদকের কাজ শুরু করলেও তাঁর অনূদিত পত্রগুলি রাজবন্দিদের বিরুদ্ধে মামলায় প্রদর্শিত হচ্ছে দেখে তিনি এ কাজ ছেড়ে দেন। অতঃপর ডক্টর এনামুল হক ১৯৩৬ সালে মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ হাই স্কুল, ১৯৩৭ সালে বারাসাত হাই স্কুল, ১৯৪১ সালে হাওড়া জেলা স্কুল এবং ১৯৪২ সালে মালদহ জেলা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি ঢাকা জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজে অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ১৯৫২ সালে তাঁকে প্রেষণে বেসরকারি দৌলতপুর কলেজে অধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হয়। ১৯৫৪ সালে তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজে বাংলার অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এর কয়েক মাসের মধ্যেই জগন্নাথ কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হলেও ওই একই বছরে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে তাঁকে যোগ দেন।

১৯৫৫ সালে পূর্ববাংলা স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড এবং ১৯৫৬ সালে পূর্ববাংলা সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালেই তাঁকে নবগঠিত বাংলা একাডেমীর প্রথম পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। ১৯৬১ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৪-১৯৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ‘কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড’এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। ১৯৬৯-১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে মুহম্মদ এনামুল হক বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য করা হয়। ১৯৭৫ সালে তিনি  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন। ১৯৮১ সালে তিনি ঢাকা জাদুঘরে আমৃত্যু সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে যোগ দেন।

মুহম্মদ এনামুল হক মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাস এবং বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ বিষয়ে দুরূহ গবেষণা কর্মে বিশেষ অবদান রেখেছেন। 

এনামুল হকের সাহিত্যকর্মের বৈশিষ্ট্য হলো সত্যানুসন্ধান ও বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা। তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের লুপ্তপ্রায় পান্ডুলিপির সন্ধান দেন। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চেতনা জাগরণই তাঁর সাহিত্য সাধনার মূল প্রেরণা। সাহিত্যের ইতিহাস সন্ধানের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য।

তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদের সঙ্গে যৌথভাবে রচিত-আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য (১৯৩৫), বঙ্গে সূফীপ্রভাব (১৯৩৫), বাঙলা ভাষার সংস্কার (১৯৪৪), মুসলিম বাঙলা সাহিত্য (১৯৫৭), A History of Sufism in Bengal (১৯৭৬), জিএম হিলালরি সঙ্গে যৌথভাবে রচিত Perso-Arabic Elements in Bengali (১৯৬৭), এছাড়া তিনি Abdul Karim Shahityavisharad Commemoration Volume (১৯৭২), Dr. Md. Shahidullah Felicitation (১৯৬৬) গ্রন্থদ্বয় সম্পাদনা করেন।

এনামুল হক তাঁর বহুমুখী প্রতিভার জন্য নানা পুরস্কারে সম্মানিত হন। তিনি ১৯৬২ সালে ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব; ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার; ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার; ১৯৭৯ সালে একুশে পদক; ১৯৮০ সালে শে-
রে বাংলা সাহিত্য পুরস্কার; ১৯৮১ সালে মুক্তধারা ও আব্দুল হাই সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। বাংলা একাডেমী তাঁর নামে ‘মুহম্মদ এনামুল হক সাহিত্য পদক’ প্রচলন করে।

সততা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের আকর্ষণীয় দিক। তাঁর যুক্তি, তথ্য, মননশীলতা ও অনুসন্ধিৎসা বাংলা ভাষার অগ্রগতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ১৯৮২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।


তারুণ্যের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য

 



তারুণ্যের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য

বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল ও পরিচিত নাম সুকান্ত ভট্টাচার্য। তিনি একাধারে কিশোর কবি, তারুণ্যের কবি এবং শোষিত গণমানুষের কবি হিসেবেও পরিচিত। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পৈত্রিক নিবাস বর্তমান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার কোটালী পাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে হলেও তিনি ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নিবারণ চন্দ্র ভট্টাচার্য ও সুনীতি দেবীর দ্বিতীয় পুত্র। এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য নয়-দশ বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করে ছিলেন। শিক্ষাজীবনে খুব বেশি কৃতিত্বের পরিচয় কবি দিতে পারেন নি। প্রবেশিকা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আরও বেশি ছাত্র আন্দোলন এবং বামপন্থী রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়লে তার ছাত্র-জীবনের এখানেই সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু সাহিত্য চর্চায় কখনও ভাটা পড়েনি। কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতা-এর কিশোর সভার প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন সম্পাদক ছিলেন। ফ্যাসিবাদ বিরোধী শিল্পী ও লেখকসংঘের পক্ষে সম্পাদনা করেছিলেন আকাল (১৯৪৪) নামের কাব্যগ্রন্থ। কবির মৃত্যুর পর অনেকগুলো গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত একমাত্র কাব্যগ্রস্থের নাম ছাড়পত্র (১৯৪৭)

তারুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত শিরে মানুষের মর্যাদা রক্ষার আহবান তাঁর কবিতায় লক্ষ্যনীয়। তাঁর কবিতা আমাদেরকে সাহসী করে উদ্দীপ্ত করে। শানিত এবং স্পষ্ট বক্তব্য তাঁর কবিতার ভাষাকে দিয়েছিল আশ্চার্য শক্তি। শানিত শব্দের এই স্পষ্টভাষী কবি বয়সে তরুণ, ভাবে, ভাষায় এবং বক্তব্যেও তরুণ। তারুণ্যের ঝলকানি ছিল তার সাহিত্যের সবখানি জুড়ে। তবে তরুণ বয়সী হৃদয়ের ভাবাবেগ দ্বারা তিনি মোটেই চালিত ছিলেন না। বরং ছিলেন অপরিণত বয়সের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রমকারী রূঢ় জীবনের কঠিন বাস্তবতার রূপকার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সামম্প্রদায়িক দাঙ্গা এসব কবিকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল। তাইতো তিনি রোম্যান্টিকতার ঢুলু ঢুলু মাদকতায় বিভোর না থেকে বাস্তবতার কঠিন আঘাত সয়ে উচ্চারণ করেন-

                কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি

                ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়

               পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসান রুটি। (মহাজীবন)


এই বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েই কবি তাঁর কবিতার প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় করেছেন অসহায় নিপীড়িত সর্বহারা মানুষের সুখ-দুঃখকে। অবহেলিত, বলহীন সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে তার কলম ছিল সক্রিয়। যাবতীয় শোষণ-বঞ্চনার বিপক্ষে ছিল দৃঢ় অবস্থান। তিনি মানবতার জয়ের জন্য লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

সমাজের অবহেলিত নিচুস্তরের মানুষ রানার -এর কথা বলতে গিয়ে যেন একটি বাক্যে অবহেলিত শ্রেণীর সকলের কথা তুলে এনেছেন।-

                ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে

                জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে। (রানার)


শুধু সমাজের নিচুশ্রেণীর অবহেলিত সাধারণ মানুষের কথা বলেই তিনি ক্ষান্ত হননি। শপথ গ্রহণ করছেন মৃত্যুর আগে সব মানুষের বাসযোগ্য সুন্দর একটা পৃথিবী গড়ে যাবেন বলে। -

                চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

                প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,

                এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-

                নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।

এধরনের অঙ্গিকার আমরা খুব বেশি কবির কবিতায় দেখি না। শুধু বয়সে নয় মনেও তরুণ বলেই কবির পক্ষে একথা বলা সম্ভব হছে। কবি নিজেই তাঁর লেখা আঠার বছর বয়স নামক কবিতায় কেন তারুণ্যের জয়গান গেয়েছেন তা উল্লেখ করেছেন এভাবে।-

              তবু আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,

              এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,

              বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী

              এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে। (আঠারো বছর বয়স)


আর কবি বিশ্বাস করেন পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ দেশের মানুষের মনে যদি তারুণ্য ভর করে তাহলেই কেবল এ দেশ এবং দেশের মানুষ মুক্তির স্বাদ পেতে পারে। তাইতো কবি এদেশের বুকে আঠারো নেমে আসার কামনা করেছেন।-

            এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়

            পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,

            এ বয়সে তাই নেই কোন সংশয়-

            এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।


তারুণ্যের চেতনায় উদ্দীপ্ত এই মহান কবি ১৯৪৭ সালের ১৩ মে, বাংলা ১৩৫৪ সালের ২৯ বৈশাখ মাত্র ২১ বছর বয়সে যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।










মাইকেল মধুসূদন দত্ত: বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার জনক এবং নবজাগরণের কবি


মাইকেল মধুসূদন দত্ত: বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার জনক এবং নবজাগরণের কবি


বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার উদগাতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সেই প্রাচীনযুগ থেকে সমগ্র মধ্যযুগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য সম্পূর্ণ রূপে ধর্মকেন্দ্রীক এবং দেব-দেবী নির্ভর। সাহিত্যে সাধারণ মানুষের স্থান ছিল না বললেই চলে। বাংলা সাহিত্য আঙ্গিক এবং চেতনাগত উভয় দিকেই ছিল প্রথাবদ্ধ এবং গতানুগতিক। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ সহজিয়াপন্থী বৌদ্ধধর্মীয় গুরুদের রচিত পদ। আকারে এবং আকৃতিতে ছোট হলেও সেগুলো আধুনিক গীতিকবিতা নয়। সহজিয়াপন্থী ধর্মীয় গুরু, যাদের সিদ্ধা বলা হয়, তাদের ধর্মীয় দর্শন সম্পর্কীত রচনা। রচনাগুলোতে তারা রহস্যময় ভাষায় তাদের গোপন সাধন তত্ত্বের কথা বলেছেন।

মধ্যযুগে এসেও বাংলা কবিতা ধর্মীয় গণ্ডী থেকে বের হতে পারেনি। বৈষ্ণব কবিরা কবিতা রচনা করলেন রাধা-কৃষ্ণর প্রেমলীলাকে নিয়ে। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার আড়ালে জাগতিক মানুষ ঢাকা পড়ে গেল। বৈষ্ণবতত্ত্ব সেখানে প্রধান হয়ে উঠল। যদিও বৈষ্ণব সাহিত্যিকরা প্রতিভাবান ছিলেন, সাহিত্যিক হিসেবে অসাধারণ উৎকর্ষ তারা দেখিয়েছেন কিন্তু ঠিক আধুনিক হয়ে ওঠা তাদের দ্বারা হলো না। জীবনকে নয়, ধর্মীয় তত্ত্বকেই তারা বড় করে দেখলেন। অন্যদিকে শাক্ত পদাবলীতে দেখা যায় শিবের মাহাত্ম্য।


জীবনী সাহিত্যের প্রাণপুরুষ শ্রীচৈতন্য। জীবনী সাহিত্য তাঁকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে।


অনুবাদ সাহিত্যও একই বৃত্তে আবর্তিত। সংস্কৃত হতে কাশিরাম দাসের মহাভারত, শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জুলেখা, হিন্দী পদুমাবৎ এর আলাওল কর্তৃক পদ্মাবতী অনুবাদ তথা মধ্যযুগের সমগ্র অনুবাদ সাহিত্যই ধর্ম নির্ভর। আমরা দেখি হিন্দু কবিদের লেখায় বৈষ্ণবতত্ত্ব, কিংবা কোন দেবদেবীর গুণগান আর মুসলিম কবিদের লেখায় সুফী তত্ত্বের আত্মা-পরমাত্মার খেলা।


মঙ্গল কাব্যেগুলোকে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো চণ্ডী-মঙ্গলে কবি মুকুন্দ রাম দেবী চণ্ডীর
গুণগান করছেন, মনসা মঙ্গলে মনসা দেবী পদ্মার গুণগাণ এবং অন্নদা মঙ্গলে দেবী অন্নপূর্ণার গুণগানে
ভরা। মঙ্গলকাব্যের এই তিনটি শাখা ছাড়াও আরও অনেক ধরনের মঙ্গলকাব্যর অস্তিত্ব বাংলা সাহিত্যে
রয়েছে এবং সবগুলোই অবধারিতভাবে কোন না কোন দেব-দেবীর মাহাত্ম্য কীর্তনের জন্য রচিত। যদিও
মুকন্দরামের ভারুদত্ত, ভারত চন্দ্রের ঈশ্বরী পাটনী এবং মনসা মঙ্গলের চাঁদ সওদাগর জীবন্ত মানুষের
প্রতিভূ। কিন্তু কাহিনীগুলোতে তারা অনুঘটক, ঘটনার অংশ মাত্র। মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ভিন্ন।

ভারত চন্দ্রের মৃত্যুর প্রায় ৪০-৫০ বছর পরে ১৮০১ সালে বাংলা সাহিত্য আধুনিক যুগে প্রবেশ করলেও সেই অর্থে আধুনিকতা তখনও ধরা দেয়নি। বাংলা সাহিত্যে গদ্যের প্রচলন হয়েছে। কবি ঈশ্বরগুপ্ত সংবাদ পত্র চালানোর পাশাপাশি সমকালীন সমাজ জীবনের নানান অসঙ্গতি নিয়ে কবিতা রচনা করছেন কিন্তু সত্যিকারের আধুনিকতাকে তিনি ধরতে পারেননি। আধুনিকতার অন্যতম যে লক্ষণ ভাবের বিপ্লব, চেতনার বিপ্লব সেখানে ঈশ্বরগুপ্তের কোন অংশগ্রহণ নেই। ঐতিহ্যকে অভ্রান্ত বলে ধরে নেয়ার প্রাচীন প্রবণতা মধ্যেই ঈশ্বরগুপ্ত আবদ্ধ হয়ে ছিলেন।

১৮৬১ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত “মেঘনাধবধ কাব্য” রচনা করে বাংলা কবিতা তথা বাংলা সাহিত্যের এই অচলায়তনকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিলেন। অছ্যুৎ রাবণকে শুধু দেশপ্রেমিক নায়কই করলেন না কবিতার আঙ্গিক প্রসাধনেও প্রচলিত পয়ারের পুরাতন বৃত্তকে ভেঙ্গে দিলেন। রামায়ণ থেকে মাইকেল তার মহাকাব্যের কাহিনীটা নিলেন কিন্তু রামায়ণের রাম মাহাত্ম্য এখানে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। মাইকেলের রচনায় এতদিনের অস্পৃশ্য রাবণ হয়ে উঠলেন কাব্যের নায়ক। লক্ষ্মণের বীরত্ব নয় অন্যায় যুদ্ধে মেঘনাদকে মেরে ফেলাটাই তার কাছে বড় হয়ে উঠল। লক্ষ্মণের কৃতকর্মকে তিনি নিন্দা জানালেন।

অন্যদিকে এতদিনের বাংলা কবিতা ছিল অক্ষরবৃত্তের পয়ারের ছাদে বাঁধা। সেখানে অমিত্রাক্ষর আবিষ্কারের মাধ্যমে মাইকেল বাংলা কবিতার চলার গতিকে মুক্তি দিলেন। এতদিন ধরে বাংলা কবিতার চলার স্বাধীনতা ছিল না। চরণগুলো চলতে পারতো কিন্তু পায়ে ছিল অক্ষরবৃত্তের পয়ারের শেকল বাধা। অক্ষরবৃত্তের পয়ারের নির্দিষ্ট ছন্দ ব্যতীত সে চলতে জানতো না। এ অবস্থায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের মাধ্যমে মধুসূদন বাংলা কাব্যের পা থেকে শেকল খুলে দিলেন।


আর এভাবেই মাইকেল বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণের সূচনা করেছিলেন।