কায়কোবাদ ও তার কাব্যপ্রতিভা

কায়কোবাদ ও তার কাব্যপ্রতিভা

বাংলা মহাকাব্যের ধারায় উল্লেখযোগ্য প্রতিভা কবি কায়কোবাদ। কবির আসল নাম মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী হলেও সাহিত্য ক্ষেত্রে তিনি কায়কোবাদ নামে পরিচিত। কবির জন্ম ঢাকা জেলায় ১৮৫৮ খ্রীস্টাব্দে। খুব বেশি পড়ালেখা তিনি করতে পারেননি। নিজ এলাকাতেই ডাক বিভাগে সামান্য বেতনের চাকুরী করে জীবন অতিবাহিত করেন। 

মহাকবি হিসেবে পরিচিত হলেও মূলত গীতি কবিতা রচনার মধ্য দিয়েই সাহিত্য-ক্ষেত্রে কবির পদার্পণ। একেবারে কিশোর বয়সে বিরহ বিলাস (১৮৭০) এবং কুসুম কানন (১৮৭৩) রচনা করেন। তবে অশ্রুমালা (১৮৯৪) লিখেই মূলত তিনি সাহিত্যিক হিসেবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। 

তিনি মনে করতেন মহাকাব্য রচনা করতে পারাতেই প্রকৃত কবির পরিচয়। মহাশ্মশান কাব্যের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন-

“সাহিত্যের বাজারে আজকাল কবিতার বড়ই ছড়াছড়ি। কিন্তু দুঃখের বিষয় বঙ্গ-সাহিত্যে মহাকাব্যের জন্ম অতি বিরল। মধুসূদনের পর হইতে আজ পর্যন্ত মহাকবি নবীনচন্দ্র ও হেমচন্দ্র ব্যতীত কয়জন কবি মহাকাব্য লিখিয়াছেন। এখনকার কবিগণ কেবল ‘নদীর জল’ ‘আকাশের তারা’ ফুলের হাসি ও প্রিয়তমার কটাক্ষ লইয়াই পাগল। প্রেমের ললিত ঝংকারে তাহাদের কর্ণ এরূপ বধির যে, অস্ত্রের ঝনঝনি বীরবৃন্দের ভীষণ হুংকার তাহাদিগের কর্ণে প্রবেশ করিতে অবসর পায় না। তাহারা কেবল প্রেমপূর্ণ খণ্ড কবিতা লিখিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেন।” 

মহাকাব্যের মধ্যে কবি প্রতিভার সম্যক বিকাশ সম্ভব মনে করে তিনি গীতি কবিতাকে কোন গুরুত্ব দিতে চাননি। তাইতো তিনি গীতিকবিতার স্বর্ণযুগে মহাকাব্য লেখার প্রয়াস পেয়েছিলেন। 

১৯০৪ খ্রীস্টাব্দে তিন খণ্ডে সমাপ্ত তার বিশাল মহাকাব্য মহাশ্মশান প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি তিনি দশ বছর ধরে লিখেছিলেন। গ্রন্থটি ষাট সর্গে ৮৭০ পৃষ্ঠা নিয়ে লেখা হয়। 

১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠাদের পরাজয় এবং আহমদ শাহ আবদালীর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীর বিজয় বর্ণনা কাব্যটির বিষয়বস্তু। এ যুদ্ধে মারাঠাদের পরাজয় এবং মুসলিম বাহিনী জয়লাভ করলেও হিন্দু-মুসলমান উভয় জাতির জীবনে যে করুন এবং মর্মান্তি পরিনতি নেমে আসে কায়কোবাদ সেটাই তুলে ধরেছেন। কবির মতে-

“একপক্ষে পানিপথ যেমন হিন্দু গৌরবের সমাধিক্ষেত্র অপর পক্ষে সেইরূপ মুসলিম গৌরবেরও মহাশ্মশান।”

ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের পরে বাংলা সাহিত্যে জাতীয়তাবোধের যে প্রেরণা জেগে উঠেছিল কায়কোবাদ তারই অনুসারি ছিলেন। ওই সময়ে বাংলা সাহিত্যে মুসলিম লেখকদের সংখ্যা ছিল অতি নগন্য। ফলে মুসলমানদের গৌরবগাঁথা কোথাও লেখা হয়নি। তারই অভাববোধ থেকে কায়কোবাদ লেখনি ধারণ করেছিলেন। 

ইসলামি জাতীয়তাবোধের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হলেও কবি কায়কোবাদের ক্ষেত্রে এটি উল্লেখযোগ্য যে, তিনি অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছিলেন। হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির মধ্যেই এদেশের কল্যাণ নিহিত বলে তিনি মনে করতেন। তাইতো তার কণ্ঠে হিন্দু-মুসলমানের মিলনবাণী ঘোষিত হয়েছে।  

                এস ভাই এস হিন্দু মুসলমান

                একস্বরে আজি গাহিব এ গান;

                আমরা দুভাই ভারত সন্তান

                দুঃখিনি ভারত মোদের মাতা।

মহাশ্মশান কাব্যের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন-

“মুসলমানগণ বীরপুরুষ, হিন্দুগণও বীরপুরুষ, এই দুই বীরজাতি হৃদয়ের উষ্ণ শোণিতে আপনাদিগের জাতীয় গৌরব ও ভীষণ বীরত্ব কালের অক্ষয়পটে লিখিয়া গিয়াছেন।------- একজাতি দেশের জন্য, ধর্মের জন্য, স্বজাতির কল্যাণের জন্য হৃদয়ের পবিত্র শোণিতে স্বদেশ প্লাবিত করিয়া বিজয় গৌরবে গৌরবান্বিত হইয়াছেন। কম কে? উভয় জাতির বীরত্বই প্রশংসার্হ। ”

কায়কোবাদের এই অসাম্প্রদায়িক মনোভাব তার কাব্যকে বিশিষ্ট করেছ। 

একথা সত্য যে, কায়কোবাদ মহাকাব্য রচনায় শিল্পগত উৎকর্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি।  

অসংখ্য কাহিনী এতে স্থান পেয়েছে কিন্তু কাহিনীগুলো যেন বিচ্ছিন্ন। কাব্যে নায়কোচিত কোন চরিত্র নেই। আহম্মদ শাহ আবদালী, নজীবউদ্দৌলা, সুজাউদ্দোলা প্রভৃতি চরিত্রের মধ্যে নায়কোচিত পূর্ণতা নেই। মহাকাব্যের চরিত্র হিসেবে তারা দুর্বল। কাহিনী আকস্মিকতায় পরিপূর্ণ। কায়কোবাদের গীতিধর্মী গদ্যাত্মক সরল ভাষা মহাকাব্যের গাম্ভীর্য হারিয়েছে। 

ডঃ আনিসুজ্জামানের মতে-

‘মহাকাব্যের গাম্ভীর্য এতে নেই, কবির রোমান্টিক প্রবণতা অনাবশ্যক প্রেমকাহিনী সন্নিবেশের কারণ। সংলাপ দুর্বল, বর্ণনা পুনরুক্তি দোষে আক্রান্ত।’

সাহিত্য সমাজে কায়কোববাদের যে স্বীকৃতি সম্পূর্ণ রূপে তা তার শিল্পদক্ষতার জন্য না হলেও মুসলিম সমাজে তা আবেগ-আপ্লুত। বৃহদায়তনের মহাশ্মশান মহাকাব্য এবং তাতে মুসলিম গৌরবের ইতিহাসের প্রচার ও স্বজাত্যবোধের যুগোপযোগী চেতনা তাকে মর্যাদার এই আসনে বসিয়েছে। শিল্পের বিচার নাও যদি করা হয় তবু একথা বলা যায় যে, তিনি যে জাতীয়তাবোধের চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করে বৃহৎ একটা মহাকাব্য দিয়েছেন তা বাংলা সাহিত্যে অবশ্যই নতুন দান। এখানেই তার প্রতিভার সার্থকতা। 






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন