![]() |
সৌজন্যে: ইত্তেফাক |
ভাষা-আন্দোলন বাঙালির জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ভাষার অধিকারের জন্য জনগণের এই অতুলনীয় সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ দেশবিভাগের পরই পূর্ববঙ্গে শুরু হয়। সাতচল্লিশের ডিসেম্বরে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে কেন্দ্রিয় পর্যায়ে শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণ পরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনে বাংলাকে অন্যান্য ভাষার সাথে অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের দাবি উত্থাপন করা হয়। কিন্তু তৎকালীন মুসলিম লীগের কিছু নেতা এ দাবির বিরোধীতা করেন। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবং ২৪ মার্চ কার্জন হলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে এবং জিন্নাহর ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ফলে সরকারের চূড়ান্ত দমননীতি নেমে আসে ছাত্রদের উপর। ছাত্র-জনতার দুর্বার শক্তির কাছে নাজিমুদ্দিন সরকার নতি স্বীকার করে। কিন্তু নাজিমুদ্দিন সরকার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে।
১৯৫২ সালের শুরুতেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আবার দানা বেঁধে ওঠে। ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন নির্লজ্জের মতো ঘোষণা করেন ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’ এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পূর্ণ ধর্মঘট ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসভা করে ও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠন করা হয়। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হবার পর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে প্রায় ৫ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর এক সুদীর্ঘ মিছিল বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। বিকালে কর্মপরিষদের জনসভায় মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম , অন্যান্য রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতারা সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার তীব্র নিন্দা করেন এবং বাংলা ভাষার দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম চালাবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। সেই দিনই, ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান দেওয়া হয়।
২১ শে ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট বানচাল করার জন্য সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে মিছিল ও গণ জমায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিতে দিতে দশজন দশজন করে রাজপথে বেরিয়ে আসে। পুলিশ ছাত্রদের উপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করেলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও আরও অনেকে শহীদ হন। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের কথা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সমগ্র দেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আতঙ্কিত পাকিস্তান সরকার পরবর্তীতে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এভাবে সফল হয় ভাষা-আন্দোলন।
মাতৃভাষার জন্য রক্ত দেয়ার ইতিহাস পৃথিবীতে ছিল না। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে রচিত দুর্লভ ইতিহাসের এ চেতনা জীবন্ত হয়ে আছে বাংলাদেশের সাহিত্যে। বাংলা সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই, যেখানে একুশের ছোঁয়া লাগেনি। গল্প, কবিতা, ছড়া, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, চলচ্চিত্র, সংগীত ইত্যাদি ক্ষেত্রে একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতি অমর হয়ে আছে। ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যে সাহিত্য রচিত হয়েছে এগুলোর মধ্যে আমরা অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, স্বদেশ ও মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ প্রভৃতি মূর্ত হতে দেখি।
ভাষা-আন্দোলনের লেখক বোদ্ধাদের ভেতরে যাঁরা আছেন তারা হলেন আলী আশরাফ, শামসুর রাহমান, জহির রায়হান, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, আব্দুল গণি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, শওকত ওসমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম, আতোয়ার রহমান, মুর্তজা বশীর, সালেহ আহম্মদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, তোফাজ্জল হোসেন, জসিম উদ্দিন, আব্দুল লতিফ, মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, আবু জাফর শামসুদ্দিন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শহীদুল্লাহ কায়সার, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুহ প্রমুখ লেখকের নাম উল্লেখযোগ্য।
বায়ান্নর চেতনাকে ধারণ করে আমাদের কথাশিল্পীরা নতুন ফসলের জন্ম দিয়েছেন। এ চেতনায় আছে জালিমের প্রতি ধিক্কার আর শহীদদের প্রতি মহান শ্রদ্ধা নিবেদন। একুশকে নিয়ে প্রথম উপন্যাস লেখেন জহির রায়হান আরেক ফাগুন (১৯৬৯) নামে। ১৯৫৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন করতে গিয়ে যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন আরেক ফাগুন তাদের কাহিনী। আরেক ফাগুন ছাড়াও শওকত ওসমানের আর্তনাদ, সেলিনা হোসেনের নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি ও যাপিত জীবন উপন্যাসের কথা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
সংখ্যার দিক থেকে উপন্যাসের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও বায়ান্নের ভাষা-আন্দোলনকে নিয়ে ছোটগল্প রচিত হয়েছে বেশ। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনে স্থান পেয়েছে পাঁচটি গল্প। এরপর ১৯৮৪ সালে রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় আরো একটি গল্প সংকলন পাওয়া যায় যাতে স্থান পেয়েছে বারোটি গল্প। এর মধ্যে আটটি নতুন গল্প বাকি চারটি একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন থেকে গৃহীত। ১৯৯১ সালে ফরিদ কবির সম্পাদিত একুশের গল্প সংকলনে মোট গল্প ছিল চৌদ্দটি। এর মধ্যে দশটি গল্প নেয়া হয় রশীদ হায়দার সম্পাদিত একুশের গল্প সংকলন থেকে ।১৯৯৯ সালে বাংলা একাডেমি থেকে হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, রশীদ হায়দার ও মোবারক হোসেন সম্পাদিত একুশের গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়। তাতে রয়েছে চুয়াল্লিশ জন লেখকের গল্প।
একুশের যে চেতনা তা থেকে বাংলাদেশের কথাসাহিত্য পল্লবিত হয়েছে এবং অতীতের যোগসূত্রকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাইতো ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত কথাসাহিত্যে মানুষ এবং সময় তার সমগ্রতা নিয়ে উঠে এসেছে। শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন এ দেশের কথাশিল্পীরা যথাযথ দিতে চেষ্টা করেছেন। ভাষা-আন্দোলনকে ঘিরে সাহিত্যচর্চা গোটা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। কোন সাহিত্যিক এখন আর একুশের চেতনার বাইরে নয়। একুশ ছিল এদেশের প্রথম রক্তাক্ত প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদী চেতনারই প্রভাব বাংলাদেশের সাহিত্যকে উত্তরোত্তর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন