গ্রীমের সূত্র(Grimm’s
Law):
ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষার নিয়মিত ধ্বনি পরিবর্তনের বিষয়টিকে সর্বপ্রথম উল্লেখ করেছিলেন ডেনিস ভাষাবিজ্ঞানী রাসমুস ক্রিস্টিয়ান রাস্ক (Rasmus
Kristian Rask)। ১৮১৪ সালে ডেনিস একাডেমি অফ সায়েন্সে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন- Undersøgelse
om det gamle nordiske eller islandske sprogs oprindelse (An investigation into
the origin of the old Norse or Icelandic Language)। প্রবন্ধে তিনি প্রাচীন আইসল্যান্ডিয় ভাষার সঙ্গে স্ক্যান্ডিনেভীয় ভাষার এবং জার্মান উপভাষাগুলির কী সম্পর্ক তা দেখিয়েছেন।
এই প্রবন্ধে রাস্ক বলেন, কিছু নির্বাচিত শব্দ নিয়ে সাদৃশ্য ভাষার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করে তাদের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করা বা একই উৎসজাত কিনা যাচাই করা ঠিক হবে না। কারণ ভৌগোলিকভাবে পাশাপাশি অবস্থান করা দুই ভাষার মধ্যে শব্দগত এই সাদৃশ্য শব্দঋণের কারণেও হতে পারে। দুটি ভাষা একে অন্যের কাছ থেকে শব্দ গ্রহণ করে থাকে। এই জন্য দুই ভাষার মধ্যে ব্যাকরণগত সাদৃশ্য কেমন আছে তা দেখতে হবে। কারণ ব্যাকরণগত পরিবর্তন ধীরে সংঘটিত হয়। এই জন্য তিনি রূপতত্ত্বের তুলনার কথা বলেন।
তুলনামূলক পদ্ধতি প্রয়োগে তার মূল কথাটি ছিল, প্রত্যেক ভাষায় কিছু অপরিহার্য শব্দ থাকে। যদি তুলনীয় দুটি ভাষার এইসব শব্দের মধ্যে প্রচুর মিল পরিলক্ষিত হয় এবং অন্য একটি ভাষায় ঐ শব্দের কোন ধ্বনি নিয়মিতভাবে (একই নিয়মে/পদ্ধতিতে) পরিবর্তিত হয় তাহলে বলা যাবে ঐ দুটি ভাষা একই উৎসজাত এবং তাদের মধ্যে মৌলিক নিকট সম্পর্ক আছে।
রাস্কের এই পর্যবেক্ষণকে প্রথম সূত্রবদ্ধ করেন জ্যাকব গ্রিম (Jacob
Grimm)। তিনি বিস্তৃত ব্যাখ্যা সহযোগে পরিবর্তনের দিকগুলোর উপর আলোকপাত করেন। গ্রিম ১৮১৯ সালে Deutsche
Grammatik নামে জার্মানিক অর্থাৎ টিউটনিক ভাষার উপর একটি ব্যাকরণ লিখেন। এতে গথিক, স্ক্যান্ডিনেভীয়, ইংরেজি, ফ্রিজিয়, ওলন্দাজ ও জার্মান ভাষার ব্যাকরণের তুলনামূলক আলোচনা করা হয়। ১৮২২ সালে ১ম খণ্ডের ২য় সংস্করণে তিনি Vonden
Buchstaben (On the letters) নামে একটি অধ্যায় জুড়ে দেন। যেখানে তিনি ধ্বনি পরিবর্তনের নিয়মকে ব্যাখ্যা করেন। পরিবর্তনটি দুটি পর্যায়ে সংঘটিত হয়। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন “সাউন্ড শিফট” (Sound-Shift)।
১ম পর্যায়ে First
Sound-Shift মূল ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষা থেকে জার্মানিক বা টিউটনিক শাখাটি পৃথক হয়ে আসার সময় যে ধ্বনি পরিবর্তন ঘটে এখানে তিনি তা ব্যাখ্যা করে দেখান। এই পরিবর্তন আনুমানিক খ্রি:পূ: ৫০০ বছর আগে ঘটে।
২য় পর্যায়ে Second
Sound-Shift বা পরিবর্তনটি সংঘটিত হয় ৭ম শতাব্দীতে। জার্মানিক থেকে ওল্ড হাই জার্মান ভাষায়।
গ্রীম ধ্বনি পরিবর্তনের যে নিয়মগুলো উল্লেখ করেছিলেন সেগুলো পরবর্তীতে ভাষাবিজ্ঞানীদের কাছে গ্রীমের সূত্র বলে পরিচিতি লাভ করে। তিনি বলেন এই পরিবর্তন ধ্বনিগত এবং নিয়মমাফিক। এই পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছিল ব্যঞ্জনধ্বনির ক্ষেত্রে। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার প্রতিনিধি হচ্ছে গ্রীক আর জার্মানিক ভাষার প্রতিনিধি হচ্ছে গথিক।
ধ্বনি পরিবর্তনটি তিনটি ধারায় ঘটেছিল।
ক) মূল ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষার অল্পপ্রাণ অঘোষ স্পৃষ্ট বা স্পর্শ ধ্বনি (un-aspirated
voiceless plosive) জার্মানিক ভাষায় মহাপ্রাণ অঘোষ উষ্ম (aspirated
voiceless fricative) ধ্বনিতে পরিণত হয়েছে।
গ্রীক(মূল ইন্দো-ইউরোপীয়) গথিক(জার্মানিক) ১ম ধ্বনি ২য় ধ্বনি
kardia hairto
(foot
- পা ) ক = খ
treis threis
(three
- তিন ) ত = থ
pous fotus
(heart
- হৃদয় ) প = ফ
খ) মূল ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষার অল্পপ্রাণ ঘোষ স্পৃষ্ট বা স্পর্শ ধ্বনি(un-aspirated
voiced plosive) জার্মানিক ভাষায় অল্পপ্রাণ অঘোষ স্পর্শ (un-aspirated
voiceless plosive) ধ্বনিতে পরিণত হয়েছে।
গ্রীক(মূল ইন্দো-ইউরোপীয়) গথিক(জার্মানিক) ৩য় ধ্বনি ১ম ধ্বনি
deka
taihun গ = ক
genos
kuni
দ = ত
-- -- ভ = প
গ) মূল ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষার ঘোষ মহাপ্রাণ স্পৃষ্ট বা স্পর্শ ধ্বনি(voiced
aspirated plosive) জার্মানিক ভাষায় ঘোষ অল্পপ্রাণ স্পর্শ (un-aspirated
voiced plosive) ধ্বনিতে পরিণত হয়েছে।
গ্রীক(মূল ইন্দো-ইউরোপীয়) গথিক(জার্মানিক ৪র্থ ধ্বনি ৩য় ধ্বনি
chortos
gards
(yard-উঠান ) ঘ = গ
thygater
dauther
(daughter- কন্যা) ধ = দ
phero
bairan
(bear -
ভাল্লুক ) ভ = ব
এই পরিবর্তনকে নিচের চিত্রের আকারে দেখান যায়-
এখানে চিত্রে-
গ্রীমের পরিভাষা/অভিধা বর্তমান পরিভাষা/অভিধা
Tenues (ক, ত, প) অল্পপ্রাণ অঘোষ স্পৃষ্ট/স্পর্শ ধ্বনি (un-aspirated
voiceless plosive)
Mediae (গ, দ, ব) অল্পপ্রাণ ঘোষ স্পৃষ্ট/স্পর্শ ধ্বনি (un-aspirated
voiced plosive)
Aspiratae
(খ, থ, ফ) মহাপ্রাণ অঘোষ উষ্ম ধ্বনি (aspirated
voiceless fricative)
অর্থাৎ মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গ্রীকে যদি T হয় তাহলে জার্মানিকে হবে M ওল্ড হাই জার্মান বা প্রাচীন উচ্চ জার্মানে A হবে এভাবে চক্রাকারে পরিবর্তনটা ঘটে।
চক্রের পরিবর্তনটা এভাবে দেখান হয়-
ইন্দো-ইউরোপীয়- T M A
জার্মানিক- A T M
প্রাচীন উচ্চ জার্মান- M A T
উদাহরণ-
গ্রীক- phrator deka thygater
গথিক- brother taithan daughtar
উচ্চ প্রাচীন জার্মানে- brooder zehan tother
Note:
অল্পপ্রাণ ধ্বনি: বর্গের ১ম, ৩য় ধ্বনি ও ৫ম ধ্বনি
মহাপ্রাণ ধ্বনি: বর্গের ২য় ও ৪র্থ ধ্বনি
অঘোষ ধ্বনি: বর্গের ১ম ও ২য় ধ্বনি
ঘোষ ধ্বনি: বর্গের ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম ধ্বনি
স্পর্শ বা স্পৃষ্ট ধ্বনি “ক” থেকে “ম” পর্যন্ত ধ্বনিগুলো
উষ্ম ধ্বনি: শ, ষ, স, হ এই চারটি ধ্বনি
জার্মানিক বা টিউটনিক ভাষা: গথিক, স্ক্যান্ডিনেভীয়, ইংরেজি, ফ্রিজিয়, ওলন্দাজ ও জার্মান ভাষা সমূহ
প্রাচীন উচ্চ জার্মান ভাষা: উচ্চ জার্মান ভাষা হচ্ছে অনেকগুলি সমগোত্রীয় উপভাষার সমষ্টিগত নাম। আদর্শ জার্মান, লুক্সেমবার্গ এবং ইডিশ ভাষার বিভিন্ন রূপ, মধ্য ও দক্ষিণ জার্মানি, অস্ট্রিয়া, লিশটেনশটাইন, সুইচারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্সের আলজাস ও লোরেন, ইতালি এবং পোলেন্ডে উচ্চ জার্মান ভাষা প্রচলিত।
উচ্চ বলতে মধ্য ও দক্ষিণ জার্মানির পার্বত্য অঞ্চল ও আল্পস পর্বতমালাকে বোঝান হয়। আর নিম্ন জার্মান বলতে উত্তর দিকের সমুদ্র তীরের সমতল ভূমিতে প্রচলিত জার্মান ভাষাকে বোঝান হয়। (সূত্র: উইকিপিডিয়া)
গ্রাসমানের সূত্র(Grassmann’s
Law):
গ্রীম
তার সূত্রের সাহায্যে মূল ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষার সাথে জার্মানিক ভাষার ধ্বনি পরিবর্তনের
প্রধান দিকগুলি দেখাতে পারলেও আরও যে ব্যতিক্রম রয়ে গেছে সেগুলো দেখাতে পারেননি। গ্রীমের
সূত্রের এই অপূর্ণতা পরবর্তী ভাষা বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন
গ্রাসমান।
গ্রীমেন
সূত্রানুসারে মূল-ইন্দোইউরোপিয় ভাষার মহাপ্রাণ ঘোষবৎ স্পর্শ ধ্বনি (bh-ভ, dh-ধ,
gh-ঘ, gwh-ঘ্ব) শুধু জার্মানিক শাখায় ঘোষবৎ অল্পপ্রাণ স্পর্শ ধ্বনিতে
(b-ব, d-দ, g-গ) পরিবর্তিত হবে কিন্তু ইন্দো-ইউরোপিয় অন্যান্য শাখায় অপরিবর্তিত থাকবে।
যেমন গথিকে ’ব’ হলে সংস্কৃততে ’ভ’ হওয়ার কথা কিন্তু এমন অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় গথিক
এবং সংস্কৃত উভয় ভাষায় ‘ব’ থেকে যায়। যেমন-
গথিক সংস্কৃত
Buidan বোধতি
অর্থাৎ
সংস্কৃত ‘বোধতি’ স্থলে ‘ভোধতি’ থাকার কথা। এই ব্যতিক্রমটাই গ্রামমান সূত্রাকারে ব্যাখ্যা
করেছিলেন। গ্রাসমানের মূল সূত্রটি হল-
মূল
ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষায় যেখানে পরপর দুটি মহাপ্রাণ ঘোষধ্বনি (bh, dh, gh, gwh)
ছিল সংস্কৃত গ্রীকে দুটি ধ্বনির মধ্যে এবটি পরিবর্তীত হয়ে অল্পপ্রাণ হয়ে যাবে।
মূল ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষায় ভোধতি শব্দে ’ভ’ ও ‘ধ’ পর পর দুটি মহাপ্রাণ ঘোষ ধ্বনি ছিল। সংস্কৃততে একটি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। ‘ভ’ স্থলে ‘ব’ হয়েছে।
ভের্নারের সূত্র (Verner’s
Law):
গ্রীমের
সূত্রের আরও কিছু ব্যতিক্রম ১৮৭৫ খ্রি: এডলফ কার্ল ভের্নার(Adolf Karl Verner) ব্যাখ্যা
করেন। তার নামানুসারেই এই সূত্রটির নাম হয় ভের্নারের সূত্র। গ্রীমের সূত্রানুসারে মূল
ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষার যেখানে অল্পপ্রাণ অঘোষ স্পর্শ ধ্বনি জার্মানিক শাখায় মহাপ্রাণ
অঘোষ উষ্ম ধ্বনিতে পরিণত হওয়ার কথা আর অন্যান্য শাখায় (গ্রীক, ল্যাটিন, সংস্কৃত) এগুলি
অপরিবর্তিত থাকার কথা। সেই অনুসারে মূল ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষায় septm থেকে-
ল্যাটিন
গ্রীক সংস্কৃত
Septem hepta সপ্ত(sapta)
কিন্তু
জার্মানিক শাখার গথিকে হবার কথা sifum (p-প স্থলে f -ফ) কিন্তু গথিকে পাওয়া যাচ্ছে sibum. কার্ল ভের্নার
এই ব্যতিক্রমটি ব্যাখ্যা করেন। তার সূত্রটি হল-
গ্রীমের সূত্রানুসারে p-প, t-ত, k-ক, kw-ক্ব পরিবর্তিত হয়ে f, ø, x, xw শুধু যদি এসব ধ্বনির আগে স্বরাঘাত (accent) থাকে। কিন্তু যদি এসব ধ্বনির পরবর্তী অক্ষরে স্বরাঘাত থাকে তবে এসব ধ্বনির অন্যবিধ পরিবর্তন হবে p-প, t-ত, k-ক, kw-ক্ব এবং s তখন হয়ে যাবে b, d, g, gw এবং z . যেমন পরবর্তী উদাহরণ sibum হয়েছে। কারণ মূলশব্দ s-এর পরবর্তী m-এ স্বরাঘাত ছিল। এই কারণে-
মূল ইন্দো-ইউরোপিয় শব্দ
kmtom
সংস্কৃত গ্রীক ল্যাটিন
শতম hekaton centum
এখানে গ্রীক এবং সংস্কৃতে t অপরিবর্তিত আছে কিন্তু গথিকে hund হয়েছে। অর্থাৎ
t পরিবর্তিত হয়ে d হয়েছে।
সহায়ক গ্রন্থ:
আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ: আধুনিক ভাষাতত্ত্ব
ড. উদয় কুমার চক্রবর্তী ও ড. নীলিমা চক্রবর্তী: ভাষাতত্ত্ব
ড: রমেশ^র শ: সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা
ড. সাইফুল্লা ও অধ্যাপক উদয় কুমার চক্রবর্তী সম্পাদিত : ভাষা বিজ্ঞান ও সাহিত্যতত্ত্ব
(নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পাঠক্রম)
সূত্রের খ*
উত্তরমুছুনদ > ত
ক > গ
এরকম হবে কি?