আলাওলের কাব্যপ্রতিভা এবং বাংলা সাহিত্যে তার অবদান


 আলাওলের কাব্যপ্রতিভা এবং বাংলা সাহিত্যে তার অবদান

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আলাওল। আনুমানিক ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে কবির জন্ম। কবির জন্মস্থান নিয়ে দুটি মত চালু আছে। কারও মতে বর্তমান ফরিদপুর জেলার ফতেয়াবাদ পরগনার  জালালপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কারও মতে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদের জোবরা গ্রামে কবির জন্ম। অভিজাত পরিবারের সন্তান আলাওল অল্প বয়সেই ভাগ্যদোষে দেশ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। বাবার সাথে নৌকায় করে যাওয়ার সময় পর্তুগীজ জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আরাকানে নীত হন। আরাকানে তিনি একজন সৈনিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও পরে নৃত্য-গীত এবং সঙ্গীত শিক্ষকের কাজ করেন। তার এ প্রতিভা অল্প দিনেই ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি একজন সঙ্গীতবিদ এবং গায়ক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। এই খ্যাতি তাকে আরাকান রাজসভার অমাত্য মহলে স্থান করে নিতে সাহায্য করে, তিনি কোরেশী মাগন ঠাকুর, সৈয়দ মুসা, সোলায়মান, মুহম্মদ খান, মজলিশ এ কুতুবের মত আরাকান রাজ অমাত্যগণের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। তাদের উৎসাহেই আলাওল একে একে রচনা করেন পদ্মাবতী, সতীময়না ও লোর চন্দ্রানী, সপ্তপয়কর, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল, সিকান্দার নামা, তোহফা এবং সঙ্গীত বিষয়ক রচনা রাগতালনামা। এছাড়াও বৈষ্ণবপদ মূলক কিছু গীতিকবিতাও তিনি রচনা করেন। 

মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভা বিদ্যাপতি, মুকুন্দরাম, চন্ডিদাস, জ্ঞানদাস, ভারতচন্দ্র এদের সাথে উচ্চারিত হয় আলাওলের নাম। আলাওলের অধিকাংশ রচনা অনুবাদ বলে অনেকে কবিকে অনুবাদের কবি বলতে চেয়েছেন। কিন্তু কোন উন প্রতিভার কবির পক্ষেই এত বিপুুল পরিমাণ রচনার অধিকারী হওয়া অন্তত মধ্যযুগে সম্ভব হয়নি। তাছাড়া আলাওল যে যথার্থই উজ্জ্বল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তা তার জীবনী এবং রচনাবলী থেকেই জানা যায়। তিনি বাল্যকালেই বাংলা, সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। ব্রজবুলি ও মঘী ভাষাও তার আয়ত্তে ছিল। 

ডঃ মুহ. এনামুল হক আলাওলকে মহাকবি বলেছেন। এ প্রশংসা আলাওলের প্রাপ্য এবং তা অতিরঞ্জন নয়। আলাওলের সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা ‘পদ্মাবতী’। কাব্যটি পরিণত কবিত্বকলার অনুপম সৃষ্টি। এটি হিন্দি কবি মালিক মুহম্মদ জায়সির পদুমাবৎ কাব্যের অনুবাদ হলেও আলাওলের পদ্মাবতী জায়সির পদুমাবৎ থেকে অনেকটা দূরে। এতে রূপক, আধ্যাত্মিকতা কেউ খুঁজলে খুঁজতে পারেন; কিন্তু সেই মরমি বৈশিষ্ট্যের চেয়ে এ কাব্যে মানুষের কাহিনিই মুখ্য। জায়সির অনেক অংশই পরিত্যক্ত, আধ্যাত্মিক অংশগুলো তো বটেই। নিজের সংযোজনা আছে মাঝেমধ্যে। এতে বোঝা যায়, মূল কাব্যের সীমার মধ্যে নতুন কিছু করার প্রয়াস আলাওলের বরাবরই ছিল। ‘পদ্মাবতী’র সাহিত্যমূল্য বিচার করতে গিয়ে দীনেশচন্দ্রসেন লিখেছেন-

“পদ্মবতী’ কাব্যে আলাওলের গভীর পাণ্ডিকত্যর পরিচয় আছে। কবি পিঙ্গলাচার্যের মগন, রগন প্রকৃতি অষ্ট মহাযানের তত্ত্ব বিচার করিয়াছেন, খণ্ডিতা, বাসকসজ্জা ও কলহান্তরিকা প্রভৃতি অষ্ট নায়িকার ভেদ বিরহের দশ অবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনা করিয়াছেন, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র লইয়া উচ্চাঙ্গের কবিরাজী কথা শুনাইয়াছেন, জ্যোতিষ শাস্ত্র সম্পর্ক লগ্নাচার্যের ন্যায় যাত্রার শুভাশুভের এবং যোগিনী চক্রের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করিয়াছেন।”


পদুমাবৎ-এ সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির রাজপুত রানি পদ্মিনীর রূপ-লাবণ্যে আকৃষ্ট হয়ে এবং রানিকে পাওয়ার জন্য অভিযান করলে রানি সহচরীদের নিয়ে জহরব্রত করেছিলেন। এই কল্পিত আখ্যানটি পদ্মাবতী কাব্যের মূল প্রসঙ্গ নয়, বরং রত্নসেন-পদ্মাবতীর প্রণয় কাহিনিই মুখ্য। জায়সির কাব্য আধ্যাত্মিক রূপক, সুফি-মরমী চেতনার উদ্বোধক। আলাওল এই কাহিনিকে মানবিক রসদৃষ্টি সম্পন্ন করেছেন। নায়িকার নামেই কাব্য, রোমান্স কাব্য, যেখানে আছে রূপবান অভিজাত নায়ক আর অনিন্দ্যসুন্দরী নায়িকা, যার রূপ বর্ণনায় আলাওল তার বইয়ের বেশ কয়েক পৃষ্ঠাই খরচ করেছেন; তাতে উপমার ছডাছড়ি বর্ণনাকে কত বর্ণাঢ্য করা যায়, তার তুলনাহীন কবিকৃতি। নায়িকার বর্ণনায় ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে চমৎকারভাবে ফারসি রীতিরও মিল ঘটাতে পেরেছেন স্বচ্ছন্দে। তীব্র প্রণয়ের সঙ্গে অভিযান, যুদ্ধবিগ্রহ, সংঘর্ষ, হিংসা-বিদ্বেষ, ষড়যন্ত্র সবই আছে, উপভোগ্যভাবেই আছে। এই কথা কেবল পদ্মাবতী নয়, রূপকথাশ্রয়ী অনুবাদ রচনা সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল এবং বীরকাহিনি সিকান্দারনামা সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। 

বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ পর্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠকবি আলাওল। মধ্যযুগে যে বাংলা সাহিত্য দেবদেবী এবং তত্ত্ব নির্ভর রচনা ছিল আলাওল সেখানে পরিপূর্ণ মানবিক। মানবিকতার জয় ঘোষনা এবং রোমান্স কাব্যেও ধারাকে পরিপুষ্টি সাধন বাংলা সাহিত্যে আলাওলের অন্যতম অবদান। একথা অনস্বীকার্য যে মধ্যযুগের বাঙালি কবি আলাওলের কাব্যসামগ্রী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চিরায়ত সম্পদ।


প্রতিভাবান এই মহাকবি আনুমানিক ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন