তারুণ্যের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য

 



তারুণ্যের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য

বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল ও পরিচিত নাম সুকান্ত ভট্টাচার্য। তিনি একাধারে কিশোর কবি, তারুণ্যের কবি এবং শোষিত গণমানুষের কবি হিসেবেও পরিচিত। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পৈত্রিক নিবাস বর্তমান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার কোটালী পাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে হলেও তিনি ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নিবারণ চন্দ্র ভট্টাচার্য ও সুনীতি দেবীর দ্বিতীয় পুত্র। এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য নয়-দশ বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করে ছিলেন। শিক্ষাজীবনে খুব বেশি কৃতিত্বের পরিচয় কবি দিতে পারেন নি। প্রবেশিকা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আরও বেশি ছাত্র আন্দোলন এবং বামপন্থী রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়লে তার ছাত্র-জীবনের এখানেই সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু সাহিত্য চর্চায় কখনও ভাটা পড়েনি। কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতা-এর কিশোর সভার প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন সম্পাদক ছিলেন। ফ্যাসিবাদ বিরোধী শিল্পী ও লেখকসংঘের পক্ষে সম্পাদনা করেছিলেন আকাল (১৯৪৪) নামের কাব্যগ্রন্থ। কবির মৃত্যুর পর অনেকগুলো গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত একমাত্র কাব্যগ্রস্থের নাম ছাড়পত্র (১৯৪৭)

তারুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত শিরে মানুষের মর্যাদা রক্ষার আহবান তাঁর কবিতায় লক্ষ্যনীয়। তাঁর কবিতা আমাদেরকে সাহসী করে উদ্দীপ্ত করে। শানিত এবং স্পষ্ট বক্তব্য তাঁর কবিতার ভাষাকে দিয়েছিল আশ্চার্য শক্তি। শানিত শব্দের এই স্পষ্টভাষী কবি বয়সে তরুণ, ভাবে, ভাষায় এবং বক্তব্যেও তরুণ। তারুণ্যের ঝলকানি ছিল তার সাহিত্যের সবখানি জুড়ে। তবে তরুণ বয়সী হৃদয়ের ভাবাবেগ দ্বারা তিনি মোটেই চালিত ছিলেন না। বরং ছিলেন অপরিণত বয়সের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রমকারী রূঢ় জীবনের কঠিন বাস্তবতার রূপকার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সামম্প্রদায়িক দাঙ্গা এসব কবিকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল। তাইতো তিনি রোম্যান্টিকতার ঢুলু ঢুলু মাদকতায় বিভোর না থেকে বাস্তবতার কঠিন আঘাত সয়ে উচ্চারণ করেন-

                কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি

                ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়

               পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসান রুটি। (মহাজীবন)


এই বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েই কবি তাঁর কবিতার প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় করেছেন অসহায় নিপীড়িত সর্বহারা মানুষের সুখ-দুঃখকে। অবহেলিত, বলহীন সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে তার কলম ছিল সক্রিয়। যাবতীয় শোষণ-বঞ্চনার বিপক্ষে ছিল দৃঢ় অবস্থান। তিনি মানবতার জয়ের জন্য লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

সমাজের অবহেলিত নিচুস্তরের মানুষ রানার -এর কথা বলতে গিয়ে যেন একটি বাক্যে অবহেলিত শ্রেণীর সকলের কথা তুলে এনেছেন।-

                ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে

                জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে। (রানার)


শুধু সমাজের নিচুশ্রেণীর অবহেলিত সাধারণ মানুষের কথা বলেই তিনি ক্ষান্ত হননি। শপথ গ্রহণ করছেন মৃত্যুর আগে সব মানুষের বাসযোগ্য সুন্দর একটা পৃথিবী গড়ে যাবেন বলে। -

                চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

                প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,

                এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-

                নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।

এধরনের অঙ্গিকার আমরা খুব বেশি কবির কবিতায় দেখি না। শুধু বয়সে নয় মনেও তরুণ বলেই কবির পক্ষে একথা বলা সম্ভব হছে। কবি নিজেই তাঁর লেখা আঠার বছর বয়স নামক কবিতায় কেন তারুণ্যের জয়গান গেয়েছেন তা উল্লেখ করেছেন এভাবে।-

              তবু আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,

              এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,

              বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী

              এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে। (আঠারো বছর বয়স)


আর কবি বিশ্বাস করেন পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ দেশের মানুষের মনে যদি তারুণ্য ভর করে তাহলেই কেবল এ দেশ এবং দেশের মানুষ মুক্তির স্বাদ পেতে পারে। তাইতো কবি এদেশের বুকে আঠারো নেমে আসার কামনা করেছেন।-

            এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়

            পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,

            এ বয়সে তাই নেই কোন সংশয়-

            এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।


তারুণ্যের চেতনায় উদ্দীপ্ত এই মহান কবি ১৯৪৭ সালের ১৩ মে, বাংলা ১৩৫৪ সালের ২৯ বৈশাখ মাত্র ২১ বছর বয়সে যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।










কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন