বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান

বাংলা সাহিত্যেকে যিনি সত্যিকার অর্থে আধুনিক ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন বলেই আজকে বাংলা সাহিত্য এতদূর অগ্রসর হতে পেরেছে। মাইকেল বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার বীজ বপন করেছিলেন কিন্তু সেটা মহীরুহে পরিণত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলমের ছোঁয়ায়। বাংলা সাহিত্যকে মহীরুহে পরিণত করতে রবীন্দ্রনাথের লেগেছে মাত্র চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর। যে বাংলা সাহিত্য কৈশরকালই পার করেনি তার ঘরেই তিনি এনে দিলেন বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ  সাহিত্য পুরস্কার নোবেল। এতে তিনি নিজেকে যেমন অন্যমাত্রার নিয়ে গেছেন তেমনি বাংলা সাহিত্যকে বসিয়ে দিয়েছেন বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে। গদ্য-পদ্য-নাট্য এক কথায় বাংলা সাহিত্যে এমন কোন ধারা নেই যা রবীন্দ্রনাথের দ্বারা পুষ্ট হয়নি। কেবল মহাকাব্য ছাড়া সাহিত্যের বাকী সব শাখাকে রবীন্দ্রনাথ অমূল্য সম্পদে পরিপূর্ণ করে গেছেন।

কাব্যসাহিত্য।।

প্রথমে আসি কাব্যসাহিত্যে- মাইকেল মহাকাব্য লিখে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার উদ্বোধন করেছিলেন কিন্তু আধুনিক গীতিকবিতার সন্ধান তিনি দিতে পারেননি। মাইকেলের পরে বিহারীলাল চক্রবর্তী এসে চেষ্টা করলেন বাংলা গীতিকবিতাকে আধুনিক করে তুলতে। তাঁর প্রচেষ্টাকে রবীন্দ্রনাথ অভিহিত করেছেন ভোরের পাখির কর্মকাণ্ডের সাথে। বিহারীলালের কবিতায় বাংলা সাহিত্যে ভোরের আভাস পাওয়া যায়। তিনি ভোরের ঘোষনা করতে পেরেছিলেন। বাংলা শিশুকবিতাকে জাগাতে পারেননি। সেই শিশুকবিতাকে রবীন্দ্রনাথ শুধু জাগালেন না, বিশ্ব-দরবার থেকে এশিয়ার প্রথম ব্যক্তি হিসেবে নোবেল এনে দিলেন। আধুনিক হিসেবে সদ্য জন্মানো শিশুকবিতাকে নোবেল পাওয়ার পর্যায়ে উন্নীত করা কোন সাধারণ ব্যাপার নয়। এ বিষয়টাকে অনুধাবন করতে পারলেই আমরা বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদানকে বুঝতে পারব। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে কবি কাহিনী লিখে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগ মূহুর্ত পর্যন্ত যতক্ষণ চেতনা ছিলো তিনি কবিতা রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন।

কথাসাহিত্য ।।

কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে বঙ্কিম সার্থক উপন্যাস রচয়িতার কৃতিত্বের দাবীদার হলেও তিনি ছিলেন রোমান্স ধারার উপন্যাসের রচয়িতা। বঙ্কিমের দুর্গেশ নন্দিনী (১৮৬৬) প্রকাশের ১৭ বছর পরে  ১৮৮৩ সালে বৌ-ঠাকুরাণীর হাট দিয়ে উপন্যাস লেখা শুরু করলেও মূলত (১৯০৩) চোখের বালি উপন্যাস লিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা উপন্যাসের মুক্তি দিলেন। চোখের বালি উপন্যাসকে ধরা হয় বাংলা সাহিত্যে প্রথম মনসতত্ত্ব বিশ্লেষণ মূলক উপন্যাস হিসেবে। এরপরে একে একে লিখলেন নৌকাডুবি (১৯০৬), গোরা (১৯১০), ঘরে বাইরে (১৯১৬), যোগাযোগ (১৯২৯), শেষের কবিতা (১৯২৯) ইত্যাদি।

কথাসাহিত্যের আরেকটি উল্লেখযোগ্য শাখা হচ্ছে ছোটগল্প। বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের প্রবর্তক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের বর্ষাযাপন কবিতায় কবি ছোটগল্পের যে সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন সেটি  এখনও প্রামাণ্য হয়ে আছে।

 

ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা,          ছোটো ছোটো দুঃখকথা

নিতান্তই সহজ সরল,

সহস্র বিস্মৃতিরাশি                      প্রত্যহ যেতেছে ভাসি

তারি দু-চারিটি অশ্রুজল।

নাহি বর্ণনার ছটা                       ঘটনার ঘনঘটা,

নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।

অন্তরে অতৃপ্তি রবে                   সাঙ্গ করি মনে হবে

শেষ হয়ে হইল না শেষ।

 

 বাংলা ছোটগল্পেকে শুধু জন্ম দেয়া নয় একেবারে বিশ্বমানের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সকল কৃতিত্ব একা রবীন্দ্রনাথের। তাঁর রচিত “গল্পগুচ্ছ” গ্রন্থের ছোটগল্পগুলো এখনও বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

নাট্যসাহিত্য।।

বাংলা সাহিত্যে আধুনিক নাটক রচনার কৃতিত্ব মাইকেল মধুসূদন দত্তের। ১৮৫৯ সালে শর্মিষ্ঠা নাটকটি তিনি রচনা করেন। এরপরে দুটি প্রহসন সহ আরও তিনটি নাটক মাইকেল লিখেছিলেন। মাইকেলের পরে সফল নাট্যকার হিসেবে আমরা পাই দীনবন্ধু মিত্র (নীলদর্পণ-১৮৬০, সধবার একাদশী-১৮৬৬), মীর মশাররফ হোসেন (জমিদার দর্পণ-১৮৭৬), গিরিশচন্দ্র (সিরাজদ্দৌলা-১৯০৫, মীরকাশীম-১৯০৬ ), দিজেন্দ্রলাল রায় (নূরজাহান-১৯০৮, সাজাহান-১৯০৯) উল্লেখযোগ্য। সমসাময়িকালে রবীন্দ্রনাথ ১৮৮১ সালে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ এবং ‘রুদ্রচন্দ্র’ লেখার মধ্য দিয়ে নাটক রচনা শুরু করেন। সর্বশেষ  ১৯৩৯ সালে ‘শ্যামা’ নামক নৃত্যনাট্য রচনার মধ্য দিয়ে তার নাটক লেখার সমাপ্তি ঘটে। সর্বমোট ৩৫টির মত নাটক তিনি রচনা করেন। শুধু সংখ্যার আধিক্য নয়, বিষয় এবং প্রকরণ বৈচিত্র্যেও তিনি সকলের উর্ধ্বে। বাংলা সাহিত্যে গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য, নৃত্যনাট্য, সাংকেটিক নাটক, রূপক নাটক, একাঙ্কিকা এসব প্রকরণের অস্তিত্ব আগে ছিল না। এগুলো রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেন।

গদ্যসাহিত্য ।।

রবীন্দ্রনাথ বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। সমাজ, সভ্যতা, রাষ্ট্রচিন্তা ধর্ম, ইতিহাস, সাহিত্যতত্ত্ব, ভাষাচিন্তা, ইত্যাদি বিষয় ছিল তাঁর লেখার বিষয়বস্তু। মননশীল চিন্তা এবং যুক্তিবাদীতা তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। সাহিত্য (১৯০৭), শব্দতত্ত্ব (১৯০৯ ), ধর্ম (১৯০৯), Nationalism (১৯১৭), সাহিত্যের পথে (১৯৩৬), সভ্যতার সংকট (১৯৪১), সাহিত্যের স্বরূপ (১৯৪৩ ) ইত্যাদি তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ সংকলন।

ভ্রমণসাহিত্য ।।

 ভ্রমণসাহিত্য রচনার বেলায়ও রবীন্দ্রনাথ যথারীতি পথিকৃত। য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র (১৮৮১), য়ুরোপ প্রবাসীর ডায়েরী (১৮৯১), রাশিয়ার চিঠি (১৯১৯), পারস্য (১৯১৯), জাপান যাত্রী (১৯৩১) এখনও ভ্রমণ সাহিত্য রচয়িতাদের প্রেরণার উৎস। 

শিশুসাহিত্য .ও অন্যান্য ।।

 রবীন্দ্রনাথের আগে শিশুসাহিত্য রচয়িতা যেমন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা রামনারায়ণ তর্কালংকার এদের রচনায় শিশুসাহিত্য ছিল নীতি উপদেশ মূলক। রবীন্দ্রনাথই প্রথম শিশুসাহিত্যকে আনন্দমুখর করে তোলেন। জ্ঞান বিতরণ নয় শিশুকে আনন্দ দেয়াই তাঁর রচনায় মুখ্য হয়ে ওঠে। মূলত শিশুসাহিত্যের প্রথম যুগটা রবীন্দ্রনাথ এবং সমসাময়িক কয়েকজনই নির্মাণ করেছিলেন।

লিখেছেন পত্রসাহিত্য, আত্মচরিত এবং স্মৃতিকথা। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র পত্রসাহিত্য আজ পর্যন্ত উনিশটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। যেমন: ছিন্নপত্র (১৩১৯), ছিন্নপত্রাবলী (১৯৬০), ভানুসিংহের পত্রাবলী, পথে ও পথের প্রান্তে এসব তাঁর উল্লেখযোগ্য পত্রসাহিত্য।

জীবনস্মৃতি (১৯১২), ছেলেবেলা (১৯৪০) ও আত্মপরিচয় (১৯৪৩), তাঁর আত্মকথামূলক গ্রন্থ।

 --০--

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন