মাইকেল মধুসূদন দত্ত: বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার জনক এবং নবজাগরণের কবি
বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার উদগাতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সেই প্রাচীনযুগ থেকে সমগ্র মধ্যযুগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য সম্পূর্ণ রূপে ধর্মকেন্দ্রীক এবং দেব-দেবী নির্ভর। সাহিত্যে সাধারণ মানুষের স্থান ছিল না বললেই চলে। বাংলা সাহিত্য আঙ্গিক এবং চেতনাগত উভয় দিকেই ছিল প্রথাবদ্ধ এবং গতানুগতিক। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ সহজিয়াপন্থী বৌদ্ধধর্মীয় গুরুদের রচিত পদ। আকারে এবং আকৃতিতে ছোট হলেও সেগুলো আধুনিক গীতিকবিতা নয়। সহজিয়াপন্থী ধর্মীয় গুরু, যাদের সিদ্ধা বলা হয়, তাদের ধর্মীয় দর্শন সম্পর্কীত রচনা। রচনাগুলোতে তারা রহস্যময় ভাষায় তাদের গোপন সাধন তত্ত্বের কথা বলেছেন।
মধ্যযুগে এসেও বাংলা কবিতা ধর্মীয় গণ্ডী থেকে বের হতে পারেনি। বৈষ্ণব কবিরা কবিতা রচনা করলেন রাধা-কৃষ্ণর প্রেমলীলাকে নিয়ে। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার আড়ালে জাগতিক মানুষ ঢাকা পড়ে গেল। বৈষ্ণবতত্ত্ব সেখানে প্রধান হয়ে উঠল। যদিও বৈষ্ণব সাহিত্যিকরা প্রতিভাবান ছিলেন, সাহিত্যিক হিসেবে অসাধারণ উৎকর্ষ তারা দেখিয়েছেন কিন্তু ঠিক আধুনিক হয়ে ওঠা তাদের দ্বারা হলো না। জীবনকে নয়, ধর্মীয় তত্ত্বকেই তারা বড় করে দেখলেন। অন্যদিকে শাক্ত পদাবলীতে দেখা যায় শিবের মাহাত্ম্য।
জীবনী সাহিত্যের প্রাণপুরুষ শ্রীচৈতন্য। জীবনী সাহিত্য তাঁকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে।
অনুবাদ সাহিত্যও একই বৃত্তে আবর্তিত। সংস্কৃত হতে কাশিরাম দাসের মহাভারত, শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জুলেখা, হিন্দী পদুমাবৎ এর আলাওল কর্তৃক পদ্মাবতী অনুবাদ তথা মধ্যযুগের সমগ্র অনুবাদ সাহিত্যই ধর্ম নির্ভর। আমরা দেখি হিন্দু কবিদের লেখায় বৈষ্ণবতত্ত্ব, কিংবা কোন দেবদেবীর গুণগান আর মুসলিম কবিদের লেখায় সুফী তত্ত্বের আত্মা-পরমাত্মার খেলা।
মঙ্গল কাব্যেগুলোকে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো চণ্ডী-মঙ্গলে কবি মুকুন্দ রাম দেবী চণ্ডীর
গুণগান করছেন, মনসা মঙ্গলে মনসা দেবী পদ্মার গুণগাণ এবং অন্নদা মঙ্গলে দেবী অন্নপূর্ণার গুণগানে
ভরা। মঙ্গলকাব্যের এই তিনটি শাখা ছাড়াও আরও অনেক ধরনের মঙ্গলকাব্যর অস্তিত্ব বাংলা সাহিত্যে
রয়েছে এবং সবগুলোই অবধারিতভাবে কোন না কোন দেব-দেবীর মাহাত্ম্য কীর্তনের জন্য রচিত। যদিও
মুকন্দরামের ভারুদত্ত, ভারত চন্দ্রের ঈশ্বরী পাটনী এবং মনসা মঙ্গলের চাঁদ সওদাগর জীবন্ত মানুষের
প্রতিভূ। কিন্তু কাহিনীগুলোতে তারা অনুঘটক, ঘটনার অংশ মাত্র। মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ভিন্ন।
ভারত চন্দ্রের মৃত্যুর প্রায় ৪০-৫০ বছর পরে ১৮০১ সালে বাংলা সাহিত্য আধুনিক যুগে প্রবেশ করলেও সেই অর্থে আধুনিকতা তখনও ধরা দেয়নি। বাংলা সাহিত্যে গদ্যের প্রচলন হয়েছে। কবি ঈশ্বরগুপ্ত সংবাদ পত্র চালানোর পাশাপাশি সমকালীন সমাজ জীবনের নানান অসঙ্গতি নিয়ে কবিতা রচনা করছেন কিন্তু সত্যিকারের আধুনিকতাকে তিনি ধরতে পারেননি। আধুনিকতার অন্যতম যে লক্ষণ ভাবের বিপ্লব, চেতনার বিপ্লব সেখানে ঈশ্বরগুপ্তের কোন অংশগ্রহণ নেই। ঐতিহ্যকে অভ্রান্ত বলে ধরে নেয়ার প্রাচীন প্রবণতা মধ্যেই ঈশ্বরগুপ্ত আবদ্ধ হয়ে ছিলেন।
১৮৬১ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত “মেঘনাধবধ কাব্য” রচনা করে বাংলা কবিতা তথা বাংলা সাহিত্যের এই অচলায়তনকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিলেন। অছ্যুৎ রাবণকে শুধু দেশপ্রেমিক নায়কই করলেন না কবিতার আঙ্গিক প্রসাধনেও প্রচলিত পয়ারের পুরাতন বৃত্তকে ভেঙ্গে দিলেন। রামায়ণ থেকে মাইকেল তার মহাকাব্যের কাহিনীটা নিলেন কিন্তু রামায়ণের রাম মাহাত্ম্য এখানে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। মাইকেলের রচনায় এতদিনের অস্পৃশ্য রাবণ হয়ে উঠলেন কাব্যের নায়ক। লক্ষ্মণের বীরত্ব নয় অন্যায় যুদ্ধে মেঘনাদকে মেরে ফেলাটাই তার কাছে বড় হয়ে উঠল। লক্ষ্মণের কৃতকর্মকে তিনি নিন্দা জানালেন।
অন্যদিকে এতদিনের বাংলা কবিতা ছিল অক্ষরবৃত্তের পয়ারের ছাদে বাঁধা। সেখানে অমিত্রাক্ষর আবিষ্কারের মাধ্যমে মাইকেল বাংলা কবিতার চলার গতিকে মুক্তি দিলেন। এতদিন ধরে বাংলা কবিতার চলার স্বাধীনতা ছিল না। চরণগুলো চলতে পারতো কিন্তু পায়ে ছিল অক্ষরবৃত্তের পয়ারের শেকল বাধা। অক্ষরবৃত্তের পয়ারের নির্দিষ্ট ছন্দ ব্যতীত সে চলতে জানতো না। এ অবস্থায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের মাধ্যমে মধুসূদন বাংলা কাব্যের পা থেকে শেকল খুলে দিলেন।
আর এভাবেই মাইকেল বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণের সূচনা করেছিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন