পল্লীকবি জসীমউদদীনের জীবন ও তার অনন্য সৃষ্টি
আমার বাড়ি যাইও ভোমর/ বসতে দিব পিঁড়ে
জল পান যে করতে দেব/ শালি ধানের চিঁড়ে। (আমার বাড়ি)
অথবা
এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে। (কবর)
কিংবা
তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়; (নিমন্ত্রণ)
এ ধরনের অসংখ্য স্নিগ্ধ পংক্তিমালার রচয়িতা যিনি তিনি আমাদের পল্লীকবি জসীমউদদীন। যিনি বাংলার পল্লীর জীবন এবং প্রকৃতিকেই তার সাহিত্য রচনার বিষয়বস্তু করেছিলেন।
কবি জসীমউদদীনের জন্ম তার মাতুতালয়ে ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে, ১৯০৩ সালে ১ জানুয়ারি। পৈত্রিক নিবাস ফরিদপুরের গোবিন্দপুরে। ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর থেকে আইএ, বিএ ডিগ্রী সমাপ্ত করেন। এরপর ১৯৩১ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ ডিগ্রী লাভ করেন। স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে ডঃ দীনেশচন্দ্র সেনের আনুকূল্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পল্লীগীতি সংগ্রাহক হিসেবে রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে নিযুক্তি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে লেকচারার পদে যোগদান করেন। ১৯৪৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকারের পাবলিসিটি বিভাগে অফিসার পদে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে প্রচার বিভাগের ডেপুটি ডাইরেক্টর পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
বাংলা সাহিত্যে জসীমউদদীন একেবারেই স্বতন্ত্র স্বর এবং সুরের একজন লেখক। অত্যন্ত সহজ, সরল ভাষায় পল্লী বাংলার জীবন ও প্রকৃতির রূপকার হিসেবে তার কাছাকাছি আর কেউ নেই। তার কবিতায় নিসর্গের মুগ্ধ করা কোন বর্ণনা নেই, বিদ্রেহের সংগ্রামী অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নেই, নেই নবজাগরণের আহবান। আছে কেবল অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় আবহমান পল্লীর সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার নির্মোহ কথন। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও অন্যান্য সকল লেখকের মত তার লেখায় ছিল না নাগরিক যান্ত্রিক জীবনের ক্লেদাক্ত প্রকাশ। এমনকি পা-িত্য প্রকাশের জন্য শিল্পতত্ত্বে জর্জরিত অলংকার বহুল লেখনিও নেই। বরং জসীমউদদীনের লেখায় সরল পল্লী জীবনের নির্মেদ সহজ প্রকাশই আমাদের বেশি আকৃষ্ট করে।
ছাত্র অবস্থাতেই ১৯২৫ সালে কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল কবির বিখ্যাত কবিতা ‘কবর’। প্রকাশিত হওয়ার পরেই কবিতাটি মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে পাঠপুস্তকে অর্ন্তভূক্ত হয়ে কবিকে বিরল সম্মান এনে দিয়েছিল। কবির প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘রাখালী’। প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয় তার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’।
কবি যে সময়ে সাহিত্য চর্চা শুরু করেছিলেন সে সময়টা ছিল বাংলা সাহিত্যে কল্লোল যুগ। কল্লোল পত্রিকাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল কল্লোল সাহিত্য গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর সকল কবি লেখকই ছিলেন উগ্রভাবে পাশ্চাত্য আধুনিকতায় বিশ্বাসী। রবন্দ্রী প্রভাব থেকে মুক্তি খুঁজতে গিয়ে তারা ইউরোপের সাহিত্য আদর্শকে আকঁড়ে ধরেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে আমদানি করেছিলেন পাশ্চাত্য আদর্শ এবং আধুনিকতা।
সাহিত্যে পাশ্চাত্য আধুনিকতার এই জোয়ারে জসীমউদদীন সম্পূর্ণ একাকী পল্লীর পথে হাঁটলেন। পাশ্চাত্য আধুনিকতার আদর্শে নাগরিক জীবনের ভাষ্যকার না হয়ে তিনি ফিরিয়ে আনলেন কাহিনীকাব্যের ঐতিহ্যগত ধারাকে। লিখলেন ‘নক্সী কাঁথারা মাঠ’, ‘সোজন বাদীয়ার ঘাট’, ‘মা যে জননী কান্দে’ এর মত কাহিনীকাব্য। পাশ্চাত্য দোলাচলে বাঙালি সংস্কৃতি যখন হারিয়ে যাচ্ছে সেই সময়ে জসীমউদদীনের সৃষ্টিকর্ম আবার বাংলার সেই চিরচেনা রূপটি ফিরিয়ে দিয়েছিল। তিনি আরেক বার বাঙালি পাঠককে মুগ্ধ করেছিলেন। ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থটি ই এম মিলফোর্ড কর্তৃক অনুদিত হয়ে The Field Of Embroidered Quilt নামে ইংরেজিতে প্রকাশিত হলে কবিকে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এনে দিয়েছিল। এছাড়াও লিখেছেন
কাব্যগ্রন্থ:
রাখালী (১৯২৭)
নক্সী কাঁথার মাঠ (১৯২৯)
বালুচর ( ১৯৩০)
ধানক্ষেত ( ১৯৩৩)
সোজন বাদিয়ার ঘাট ( ১৯৩৪)
হাসু ( ১৯৩৮)
রূপবতী ( ১৯৪৬)
মাটির কান্না ( ১৯৫১)
এক পয়সার বাঁশী ( ১৯৫৬)
সকিনা ( ১৯৫৯)
সুচয়নী ( ১৯৬১)
ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৬২)
মা যে জননী কান্দে ( ১৯৬৩)
হলুদ বরণী ( ১৯৬৬)
জলে লেখন (১৯৬৯)
পদ্ম নদীর দেশে (১৯৬৯)
মাগো জ্বালায়ে রাখিস আলো (১৯৭৬)
কাফনের মিছিল (১৯৭৮)
মহরম
দু মুখো চাঁদ পাহাড়ী (১৯৮৭)
নাটক:
পদ্মাপার ( ১৯৫০)
বেদের মেয়ে ( ১৯৫২)
মধুমালা ( ১৯৫১)
পল্লীবধূ (১৯৫৬)
গ্রামের মেয়ে (১৯৫৯)
ওগো পুষ্পধনু (১৯৬৮)
আসমান সিংহ (১৯৮৬)
ভ্রমণকাহিনী :
চলে মুসাফির (১৯৫২)
হলদে পরীর দেশে (১৯৬৭)
যে দেশে মানুষ বড় (১৯৬৮)
জার্মানীর শহরে বন্দরে (১৯৭৫)
কথাশিল্পী হিসেবেও তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। যেমন-
বাঙালীর হাসির গল্প (১ম খণ্ড-১৯৬০) (২য খণ্ড-১৯৬৪)
ডালিম কুমার (১৯৮৬)
উপন্যাস :
বোবা কাহিনী (১৯৬৪)
আত্মজীবনী :
যাদের দেখেছি (১৯৫১)
ঠাকুর বাড়ির আঙিনা (১৯৬১)
জীবন কথা (১৯৬৪)
স্মৃতিপট (১৯৬৪)
স্মরণের সরণী বাহি (১৯৭৮)
সঙ্গীত:
রঙিলা নায়ের মাঝি ( ১৯৩৫)
গাঙের পাড় (১৯৬৪)
জারি গান (১৯৬৮)
মুর্শিদী গান (১৯৭৭)
সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি অনেকগুলো পুরস্কার লাভ করেছিলেন। যেমন-
১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্টস এওয়ার্ড ফর প্রাইড অফ পারফরশ্রান্স (পাকিস্তান )
১৯৬৯ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট ডিগ্রি, (ভারত)
১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার (বাংলাদেশ- প্রত্যাখ্যান)
১৯৭৬ সালে একুশে পদক (বাংলাদেশ)
১৯৭৮ স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (বাংলাদেশ-মরণোত্তর)
মূলত আধুনিক মননের অধিকারী পল্লী জীবন ও প্রকৃতির সহজ সরল রূপকার হিসেবে জসীমউদদীন সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবেন। তিনি ১৯৭৬ সালে ১৩ মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন