হীনযান ও মহাযান কী?

 


হীনযান ও মহাযান কী?

 

সিদ্ধার্থ গৌতম তার প্রবর্তিত বৌদ্ধধর্মে স্বর্গ প্রাপ্তি নয়, নির্বাণ লাভকেই চরম ও পরম লক্ষ্য বলে উল্লেখ করেছেন। এই নির্বাণ কী? এক কথায় নির্বাণ হচ্ছে যাবতীয় জাগতিক তৃষ্ণার নির্বাপণ বা ক্ষয় ঘটানো। তৃষ্ণাই সমস্ত দুঃখের মূল কারণ। সুতরাং তৃষ্ণাকে রুদ্ধ করতে পারলে দুঃখের উৎপত্তির মূলোৎপাদন হবে। এভাবে দুঃখ থেকে পরম মুক্তি মিলবে। জন্মান্তর রুদ্ধ হবে। কর্মের আর উৎপত্তি হবে না। সবকিছু শূন্য, স্থির হয়ে যাবে।

নির্বাণ প্রাপ্তির জন্য তিনি নির্দেশ  করেছেন সুনিদিষ্ট পথ বা পন্থার। এই পথ বা পন্থা বা পদ্ধতিকেই বলা হয়েছে যান বা সাধন পদ্ধতি। কিন্তু এই পদ্ধতি বা পথ কী বা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পরে তার শিষ্যমণ্ডলীর মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। বুদ্ধের শিষ্যমণ্ডলী দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। যদিও গৌতম বুদ্ধ এ ধরনের কোন যানের কথা কখনও কোথাও বলেননি। হীনযান এবং মহাযান এই নামকরণগুলো মূলত মহাযানীরাই করেছিলেন। কারণ তারা কেবল নিজেদের কথা চিন্তা না করে সকলকে সাথে নিয়ে মুক্তির কথা বলতেন তাই তারা নিজেদেরকে উত্তম, মহান বা মহৎ  বলতেন। অন্যদিকে হীনযানীরা কেবল নিজের মুক্তির জন্য চেষ্টা করতেন তাই তাদেরকে মহাযানীরা অধম বা হীন বলতেন। ক্ষুদ্র অর্থেও হীন শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আর যান অর্থ গাড়ি বা বাহন।  হীনযানী মতবাদকে থেরবাদ বা স্থবিরবাদও বলা হয়।

বুদ্ধের সময়ে অনেক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বুদ্ধের বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদী মতকে খণ্ডন করতে না পেরে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেও তারা হিন্দু ধর্মের সংস্কার থেকে মুক্ত ছিলেন না। ফলে তারা মনের ভেতরে বুদ্ধের মতবাদের সাথে তাদের পূর্ব সংস্কারের ও চিন্তাধারার সমন্বয় করার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর তারাই বৌদ্ধধর্মের আদর্শ এবং রীতি-নীতি নিয়ে ভিক্ষুসংঘের ভেতরে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ফলে নবীন পন্থী সংস্কারবাদী এবং প্রাচীনপন্থী রক্ষণশীল দুটি দলের উদ্ভব হলো। প্রাচীরপন্থীরা বুদ্ধ প্রবর্তিত কঠোর নিয়ম পালনের পক্ষে। অন্যদিকে নবীন পন্থীরা ধর্মে পরিবর্তন এবং নিয়ম শিথিল করে পালনের পক্ষে।

বাংলাপিডিয়ার মতে- ”মহাযানীরা  বোধিসত্ত্ব মতবাদে বিশ্বাসী। বোধিসত্ত্ব হচ্ছেন তিনি, যিনি বারবার জন্মগ্রহণ করেন এবং অপরের পাপ দুঃখভার গ্রহণ করে তাদের আর্তি দূর করেন। তিনি একা নির্বাণ বা মুক্তি লাভ না করে বরং জগতের সকলের মুক্তির জন্য কাজ করেন এবং প্রত্যেক জীবের মুক্তি অর্জনের পর তিনি পরিনির্বাপিত হন। মহাযানের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে এই বোধিসত্ত্বের আদর্শ অর্জন করা।

অন্যদিকে থেরবাদী বা হীনযানীরা- বুদ্ধের প্রদর্শিত নীতি-আদর্শ অনুসারে নিজের অন্তঃকরণ হতে অবিদ্যা, তৃষ্ণা মোহ ধ্বংস করে শমথ বিদর্শন ভাবনায় (ধ্যান) পূর্ণতা অর্জনপূর্বক নির্বাণ লাভ এবং নির্বাণোত্তর বুদ্ধস্থানে উন্নীত হওয়ার সাধনা করে।”

বুদ্ধ প্রদত্ত মূল উপদেশ বা বাণীগুলো নিয়ে উভয় মতবাদীদের মধ্যে কোন বিরোধ ছিল না। উভয় সম্প্রদায় বুদ্ধবাণীর একই বিনয় ব্যবহার করতো। তাদের আলাদা আলাদা কোন বিনয় পুস্তক ছিল না। মূল তফাৎটা ছিল জীবনকে নির্বাণ লাভের সাধন পদ্ধতি নিয়ে।

হীনযানী বা থেরবাদীরা মনে করতেন সাধনার মূল উদ্দেশ্য নির্বাণ লাভ। আর নির্বাণ লাভ হবে ধ্যান এবং অন্যান্য নৈতিক আচার আচরণের অতি নিষ্ঠাপূর্ণ চর্চা বা সাধনার মাধ্যমে। এখানে সাধককে সাধনা করতে হবে শূন্যতার। যে সাধনাকে পাওয়া যাবে অস্তিত্বকে অনস্তিত্বে বিলুপ্ত করে দেওয়ার মাধ্যমে।

মহাযানীরা মনে করেন হীনযানীদের শূন্যতার সাধনা ধর্মাদর্শ হিসেবে ঠিক নয়। তাদের কাছে নির্বাণ লাভ করার চেয়ে বোধিচিত্তের অধিকার লাভই প্রধান।

ভিক্ষুসংঘের মধ্যে সৃষ্ট এই মতভেদ দূর করার জন্য খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৩ সালে বৈশালীতে ২য় বৌদ্ধ-সংগীতি (সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হলেও মতবেদ দূর না হয়ে স্থবিরবাদ এবং মহাসাংঘিক এই দুই ভাগের সৃষ্টি হয়।

২৪৮ বা ২৫৩ খ্রি:পূর্বাব্দে সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় পাটলিপুত্রে ৩য় বৌদ্ধ-সংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। তাতে স্থবিরবাদই সর্বসম্মতভাবে বুদ্ধবাণী হিসেবে গৃহীত হয় এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের সংঘ থেকে বহিষ্কার করা হয়। অশোক ছিলেন স্থবিরবাদের পক্ষে।

এর প্রায় ৩৫০ বছর পরে ৭৮ খ্রি: কুষান রাজা কনিষ্কের আমলে জলন্ধরে মহাসাংঘিকদের উদ্যোগে ৪র্থ বৌদ্ধ-সংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। এখানেই ত্রিপিটক সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয় এবং হীনযান ও মহাযান পন্থা চুড়ান্তভাবে আলাদা হয়ে যায়।

 

হীনযান ও মহাযানের মধ্যে পার্থক্য:

১। হীনযানীরা বুদ্ধকে একজন মানুষ হিসেবে স্বীকার্ করেন, কোন ঈশ্বর, সৃষ্টিকর্তা বা অবতার হিসেবে নয়। বুদ্ধ তাদের কাছে একজন অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী পথপ্রদর্শক, শিক্ষক। হীনযানীরা বুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন বা প্রতীককে পবিত্র মনে করেন।  

মহাযানপন্থীরা বুদ্ধকে একজন অবতার রূপে কল্পনা করেন। যিনি পাপী-তাপীর ত্রাণকর্তা বা ঈশ্বর। সাধারণ মানুষ ঈশ্বরের পূজা করার মত বুদ্ধেরও পূজা করতে পারে, তার কাছে করুণা এবং সাহায্য প্রার্থী হতে পারে। বৌদ্ধধর্মে বুদ্ধমূর্তি পূজার প্রচলন ঘটিয়েছেন মূলত মহাযানীরা। ভবিষ্যতে আর্যমিত্র বুদ্ধের আগমনের প্রবক্তাও তারা। কারণ তারা বিশ্বাস করেন বুদ্ধ নির্বাণ লাভ করলেও তিনি আমাদের মধ্যে আছেন এবং প্রয়োজনে মানুষের কল্যাণে আবার পৃথিবীতে অবতীর্ণ হবেন।

২। হীনযানীরা বুদ্ধের বুদ্ধত্ব লাভের পরবর্তী জীবন এবং তার মুখনিঃসৃত বাণীকে অনুসরণ করার পক্ষপাতী। তাদের মতে কেউ কাউকে মুক্তি দিতে পারে না। বুদ্ধ প্রদর্শিত পথেই সবাইকে মুক্তি লাভ করতে হয়।

মহাযানীদের লক্ষ্য সর্বসাধারণের মুক্তি। তারা বুদ্ধের বোধিসত্ত্ব অর্থাৎ বুদ্ধত্ব লাভের আগের জীবন অনুসরণ করার পক্ষপাতী। বুদ্ধবাণী নয় বুদ্ধের বুদ্ধত্ব লাভের আগের জীবন তাদের কাছে আদর্শ। বুদ্ধ যেমন জন্মে জন্মে পারমী পূর্ণ করে নির্বাণ গমন না করে সমস্ত জীবজগতের প্রতি মৈত্রী প্রদর্শন করে সকলের মুক্তির জন্য ধর্ম প্রচার করেছিলেন, তারপরে নির্বাণ লাভ করেছিলেন, তেমনি মহাযানীরাও জগতের একটি প্রাণীও নির্বাণ লাভ থেকে দূরে থাকলে তারা নির্বাণের জন্য ব্যস্ত হবেন না। অর্থাৎ সবাইকে উদ্ধার করে তারপর নির্বাণে যাবেন। ‍

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- হীনযানীরা বাজার থেকে চাল কিনে রান্নার পক্ষপাতী, অন্যদিকে মহাযানীরা চাষাবাদ করে সেই চাল বের করে সেই চাল দিয়ে রান্নার পক্ষপাতী।

৩। হীনযানীরা নিত্য আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়। পরমাত্মায় তারা বিশ্বাস করে না। তাদের মতে মানুষের চিন্তা, অনুভূতি ইত্যাদি মানসিক ক্রিয়ার প্রবাহকে ব্যবহারিক অর্থে আত্মা বললেও বলা যেতে পারে।

মহাযানীদের মতে ব্যক্তি বা বস্তুর স্বতন্ত্র সত্তা না থাকলেও পরম সত্তা আছে। দৃশ্যমান ব্যক্তিসত্তা পরম সত্তারই বহি:প্রকাশ মাত্র।

৪। হীনযানীদের মতে মানুষ মাত্রই স্বতন্ত্র একটি প্রাণী। লৌকিক জগতে আমরা একে অন্যের আত্মীয় হলেও আধ্যাত্মিক দিক থেকে একে অপরের সাথে আমাদের কারও কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং যার যার কর্মের দায়ভার তার তার। কারও কর্ম বা মুক্তি অন্যের সাথে জড়িত নয়।

মহাযানীদের মতে সমস্ত জীবই এক। সমস্ত প্রাণিজগত এক সূত্রে গ্রথিত। এখানে একক অস্তিত্বের কোন মূল্য নেই। মানুষ একে অপরের সাথে সম্বন্ধযুক্ত এবং নির্ভরশীল।

৫। হীনযানীরা দূরকল্পনা বা অধিবিদ্যাকে মিথ্যা দৃষ্টি বলেছেন। তাই তাদের সাধনায় স্বর্গ-নরক নেই।

মহাযানীরা দূরকল্পনার সাহায্যে স্বর্গ-নরকের অস্তিত্বের কথা বলেছেন। অনেক বোধিসত্ব এবং দেবদেবীর কথা বলেছেন।

৬। হীনযানীরা বুদ্ধবাণীকে প্রামাণ্য হিসেবে গ্রহণ করে অক্ষরে অক্ষরে পালনে বিশ্বাসী। তারা ধর্মের বিশুদ্ধতা রক্ষায় তৎপর। বিনয় বিধানের সামান্য ব্যতিক্রম বা শৈতিল্যও তারা মানতে রাজী নয়।

অন্যদিকে মহাযানীরা বৃহত্তর কল্যাণে ধর্মের পরিবর্তন বা পরিবর্ধনে কুণ্ঠিত নয়। তারা বহু পরবর্তীকালে প্রণীত সূত্রগুলোকেও মান্য বলে মনে নিয়েছেন। তারা ধর্মের উপযোগীতা বাড়াতে তৎপর।

৭। হীনযানীরা ভিক্ষু সংঘকে সম্ভ্রমপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখেন। বুদ্ধের অবর্তমানে ভিক্ষু সংঘকে তারা ধর্মোপদেশ ও আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ প্রদর্শক মনে করেন।

মহাযানীদের মতে বৌদ্ধ ধর্মের নীতি ও বিধানগুলি সকলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং সমানভাবে প্রযোজ্য। তারা সবাই বোধিসত্ত্ব হবার আশায় এবং জগতের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে উৎসর্গীকৃত প্রাণ। প্রয়োজন হলে নিজের জীবন দিয়ে হলেও তারা অপরের কল্যাণ সাধনায় ব্রতী হন। যে কারণে মহযানীরা সমভাবে সংসার ধর্মও পালন করেন।

৮। হীনযানীরা পালি ভাষায় ধর্মের প্রচার করতেন। মহাযানীরা ব্যবহার করতেন সংস্কৃত ভাষা।


গ্রন্থ সহায়তা-

১। চর্যাপদ-অতীন্দ্র মজুমদার

২। বৌদ্ধধর্মে কর্মবাদ বনাম সৃষ্টি-রহস্য- জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়া

৩। উইকিপিডিয়া

৪। বাংলাপিডিয়া

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন