“মেঘনাদবধ কাব্য”র শুরু এভাবে-
রাবণ কাব্যদেবীকে আক্ষেপ করে বলছেন- যুদ্ধে বীরবাহু মারা গেলে, ইদ্রজিৎকে সেনাপতি করে পাঠালাম কিন্তু কিভাবে তাকেও নিহত করে ইন্দ্রকে শঙ্কাহীন করা হল?
কবি মাইকের মধূসূদন দত্ত কাব্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর কাছে বর প্রার্থনা করছেন দেবী তাকেও যেন বাল্মীকির মত বর দেন। যেভাবে দেবীর বরে রত্নাকর দস্যু থেকে রামায়ণ রচনাকারী বাল্মীকি ঋষিতে পরিণত হয়েছিলেন। দেবীর বরে তিনি বীর রসের কাব্য রচনা করতে চান। যেন গৌড়ের (বাংলার) লোকেরা চিরকাল আনন্দে সে কাব্যের সুধা পান করতে পারেন।
রাবণ স্বর্ণ সিংহাসনে বসে দূতের কাছ থেকে শুনছেন কিভাবে তার ছেলে বীরবাহু নিহত হল তার সংবাদ। চারিদদিকে ঘিরে আছে পাত্র-মিত্র, সভাসদ ইত্যাদি। প্রাচুর্যে ভরা অসাধারণ সুন্দর প্রাসাদ যেটা ময় দানবের ইন্দ্রপ্রস্থে গড়া প্রাসাদকেও হার মানায়। দূত বর্ণনা করছেন কিভাবে বীরবাহু যুদ্ধে গিয়ে নিহত হলেন। কিন্তু দূতের কথা রাবণের অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে-“ফুলদল দিয়া কাটিলা কি বিধাতা শাল্মলী তরুবরে?” অর্থাৎ ফুলের পাপড়ী দিয়ে কিভাবে বিধাতা শিমূল বৃক্ষকে কাটলেন?
তারপর রাবণ নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। কাঠুড়ে যেমন বনের বড় গাছ কাটার আগে একে একে সব ডাল কেটে তারপর গোড়া কাটে তেমনি কি বিধাতাও একে একে লঙ্কাকে বীর শূন্য করে তারপর তার পতন ঘটাবেন? ছোটবোন সূর্পণখার প্রতি আক্ষেপ করে বলছেন, কেন যে তুই বিষে ভরা কালসাপটাকে (রামকে) পঞ্চবটী বনে দেখতে পেলি। নইলে তো লঙ্কার আজ এই দুর্দশা হতো না। মনে হচ্ছে স্বর্ণ লঙ্কা ছেড়ে বনবাসে যাই।
রাবণের এই অবস্থা দেখে, আকাশচুম্বী পর্বত চূড়া ভেঙ্গে গুঁড়া হয়ে গেলেও তার জন্য পৃথিবীর শোক করা উচিত নয় বলে মন্ত্রী সারণ তাকে পুত্রশোক না করতে সান্ত¡না দেন। রাবণ দূতকে আবার নির্দেশ দেন ঘটনা বর্ণনা করতে। দূত বর্ণনা করতে থাকে কিভাবে রামের সঙ্গে বীরবাহুর যুদ্ধ হল এবং বীরবাহু যুদ্ধে নিহত হল।
শুনে রাবণ বিষাদ মেশান গর্বিত স্বরে বললেন, ‘ধন্য লঙ্কা বীরপুত্রধারী।’ তারপর বীরবাহুর মৃতদেহ কোথায় পড়ে আছে দেখার জন্য পাত্র-মিত্র নিয়ে প্রাসাদ শিখরে উঠলেন। প্রথমে দেখলেন প্রাচুর্যে ভরা অসাধারণ সুন্দর লঙ্কাপুরীকে। তারপর প্রাচীর বেষ্টিত লঙ্কার চারটি সিংহদরজা রাম বাহিনীর কার কার নেতৃত্বে অবরোধ করে রাখা হয়েছে। পূর্ব দুয়ারে বীর নীল, দক্ষিণ দুয়ারে অঙ্গদ, উত্তর দুয়ারে রাজা সুগ্রীব, পশ্চিম দুয়ারে স্বয়ং রাম, লক্ষ্মণ, হনুমান এবং বিভীষণ। তার অদূরে দেখলেন যুদ্ধক্ষেত্রের দৃশ্য। কিভাবে মৃত সৈন্য, হাতি, ঘোড়া, অস্ত্র, রথ ইত্যাদি রক্তস্রোতের মধ্যে পড়ে আছে। আর মাংশাসী পশুরা কিভাবে সেসব নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি, কাড়াকাড়ি-টানাটানি, মারামারি করছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকা মৃত বীরবাহুকে দেখে তিনি একই সঙ্গে গর্ব অনুভব করলেন আবার শোকে কাতর হয়ে গেলেন।
তারপরে তার চোখ গেল সাগরের দিকে। দেখতে পেলেন রামের নির্মিত সেতু কিভাবে সাগরে ভাসছে। রাজপথের মত বিশাল সেই সেতু দিয়ে অগণিত শত্রুদল আসা-যাওয়া করছে। সাগরের প্রতি মিনতি করছেন সেতু ভাসিয়ে নিয়ে শত্রুদলকে ডুবিয়ে নিজেকে কলঙ্ক মুক্ত করতে।
এরপরে আবার সভায় এসে বসলেন। চারিদিকে নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশ। এমন সময় বীরবাহুর মা চিত্রাঙ্গদা সঙ্গীনীদের নিয়ে সভায় প্রবেশ করলে তার অবস্থা দেখ সেখানে কান্নার রোল উঠল। চিত্রাঙ্গদা রাবণের কাছে পুত্রের সন্ধান চাইলেন, রাজার কাছে নিরাপদ ভেবে মানুষ সম্পদ গচ্ছিত রাখে, আমার সে ধন কোথায়? রাবণ বললেন বীরমাতার পুত্রের জন্য শোক করা উচিত নয়। তখন চিত্রাঙ্গদা রাবণের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনার নিজের দোষ নিজে ডুবতে বসেছেন আর লঙ্কাকেও ডুবাতে বসেছেন।
চিত্রাঙ্গদা চলে গেলে রাবণ নিজেই যুদ্ধে যাবেন বলে যুদ্ধসজ্জার আদেশ দিলেন। রাবণের যুদ্ধ সজ্জায় লঙ্কা কেঁপে উঠল। আলোড়ন সৃষ্টি হল জলেও। জলের তলে বারুণী দেবীর আসন নড়ে উঠল। বারুণী দেবী ভাবলেন আবার বুঝি ঝড় শুরু হয়েছে। বারুণী ভাবলেন তাহলে কী তার কিঙ্করীদের বিনিময়ে দুষ্টু বায়ুদের বন্দী করে ঝড় উঠাবেন না বলে পবন দেবের সঙ্গে তার, ইন্দ্রের সভায় যে চুক্তি হয়েছিল পবন দেব সেটা ভেঙ্গে ফেলেছেন? তখন তার সখী মুরলা বললো, এটি ঝড় নয়। রাবণের যুদ্ধসজ্জা।
তখন বারুণী দেবী যুদ্ধের খবর জানার জন্য মুরলাকে কমলা দেবীর (লক্ষ্মী) কাছে পাঠালেন। মুরলা জল থেকে উঠে কমলা দেবীর সঙ্গে লঙ্কায় এসে দেখা করলো। কমলা দেবী মুরলাকে নিয়ে কে কে যুদ্ধে যাচ্ছে তা দেখার জন্য রাক্ষস নারীর ছদ্মবেশ ধারণ করে ঘর থেকে বের হলেন।
শত শত যোদ্ধা স্রোতের মত রাজপথ ধরে চলমান। তাদের মাথার উপর রাক্ষস রমনীরা বাড়ির দরজা থেকে মঙ্গলধ্বনি তুলে ফুল ছিটাচ্ছে। তাদের ভেতর কালনেমি, বিরুপাক্ষ, তালজঙ্ঘা ইত্যাদি রাক্ষস বীরকে চিনিয়ে দিলেন। মুরলা কমলা দেবীর কাছে জানতে চায়, ইন্দ্রজিৎকে দেখা যাচ্ছে না কেন? নাকি যুদ্ধে সে মারা গেছে? কমলা বললেন, মেঘনাদ মরেনি। সে প্রমোদ উদ্যানে আনন্দ করছে।
বীরবাহুর নিহত হওয়ার সংবাদ জানাতে মুরলাকে বারুণীর কাছে পাঠিয়ে দিয়ে দেবী কমলা প্রমোদ উদ্যানে মেঘনাদের কাছে চলে গেলেন। তাকে যুদ্ধে আনতে হবে। কমলা দেবী মেঘনাদের ধাত্রীমাতা প্রভাষার ছদ্মবেশ ধারণ করে মেঘনাদকে যুদ্ধে যেতে উৎসাহ দিলেন। প্রভাষা রূপী দেবীর কথা শুনে মেঘনাদ গলায় ঝুলানো ফুলের মালা ছিড়ে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উদ্যান ত্যাগ করতে উদ্যত হলে তার স্ত্রী প্রমিলা ‘আমাকে ফেলে কোথায় যাও’ বলে বাঁধা দেন। রামকে হত্যা করে শীঘ্রই তোমার কাছে ফিরে আসব বলে মেঘনাদ চলে যান। রাবণের কাছে এসে বলেন- আমি তোমার ছেলে বেঁচে থাকতে যদি তুমি যুদ্ধে যাও তবে পুত্র হিসেবে আমার কপালে কলঙ্ক রচিত হবে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাবণ তাকে যুদ্ধে যেতে অনুমতি দিলেন। কারণ লক্ষণ শুভ নয়। একে একে তার সব বীরেরা মারা যাচ্ছে। সূর্য ডুবতে বসেছে তাই সেদিন যুদ্ধে না গিয়ে ইষ্ট দেবতাকে পূজা করে, নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সেরে পরদিন প্রভাতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে উপদেশ দিয়ে গঙ্গাজলে মেঘনাদকে সেনাপতি পদে বরণ করে নিলেন। চারিদিকে বাদ্য-বাজনা বেজে উঠল রাক্ষসরা নাচতে লাগল। জয় ধ্বনিতে লঙ্কা মুখরিত হয়ে উঠল।
২য় সর্গ: অস্ত্রলাভো
দিন চলে গেলে গোধূলি শেষে স্বর্গে রাত নামল। দেবী কমলা ইন্দ্রের সভায় আসলেন। দেবরাজ ইন্দ্র দেবীর চরণে প্রণাম করে আগমেনের হেতু জানতে চাইলেন। দেবী ইন্দ্রকে খুলে বললেন, তার আগমনের কারণ। রাবণের ভক্তি, পূজা পেয়ে লঙ্কায় সুখে বাস করলেও রাবণ নিজের পাপে আজ নিজে নিমজ্জিত। সঙ্গে লঙ্কাতে ডুবাতে বসেছেন। কিন্তু দেবীর ভয় রামকে নিয়ে। বীর শূন্য লঙ্কায় একমাত্র জীবিত বীর মেঘনাদ। তার শক্তি সম্পর্কে সকলে অবগত আছে। ভোর হলেই মেঘনাদ রামকে আক্রমণ করবে। নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সেরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে তাকে কেউ পরাস্ত করতে পারবে না। তখন রামের কি হবে? মেঘনাদ দেবরাজ ইন্দ্রেরও শত্রু। ইন্দ্র বললেন, এ ঘোর বিপদে শিব ব্যতীত উদ্ধারকর্তা কেউ নেই।
স্ত্রী শচীকে দেবী নিয়ে ইন্দ্র কৈলাসে গেলেন। উমা দেবীকে আগমনের হেতু বিস্তারিত জানালেন। উমা দেবী বললেন স্বয়ং শিব রাক্ষসকূলকে রক্ষা করেন, সুতরাং তার ইচ্ছা ছাড়া কিছু করা সম্ভব নয়। কিন্তু এখন শিব ধ্যানে মগ্ন কিভাবে তার কাছে যাওয়া যাবে। ইন্দ্র আবারও দেবী পার্বতীকে (উমা/দুর্গা/বিজয়া) অনুরোধ করলেন একমাত্র তিনিই শিবের কাছে যেতে পারবেন। নয়তো পরদিন যুদ্ধে রাম নিহত হলে পৃথিবী রসাতলে যাবে। এমন সময় সুগন্ধে চারিদিক ভরে গেল, শঙ্খধ্বনি শোনা গেল, দেবী বিজয়া জানতে পারলেন মর্ত্যে রামচন্দ্র তাকে পূজা করছেন। উমা দেবী কামদেবের স্ত্রী রতি দেবীকে স্মরণ করলেন। রতি দেবী এসে মহাদেবের(শিব) কাছে যাওয়ার জন্য উমাকে মনোহর সাজে সাজিয়ে দিলেন। উমা দেবী ম্বামীকে প্রেম মেশান মধুর স্বরে ডাকলেন, তখনই সেখানে রতি দেবীর স্বামী প্রেমরূপী কামদেব(প্রেমের দেবতা) উপস্থিত হলেন। দেবী তাকে বললেন ‘চল আমার সঙ্গে। শিবের কাছে।’ উমার কথা শুনে, ইতোপূর্বে অকালে শিবের ধ্যান ভঙ্গ করাতে তাকে পুড়ে ভস্ম হতে হয়েছিল এ ঘটনা স্মরণ করে মদন(কামদেব) ভয় পেলেন। উমা, মদনকে অভয় দিলেন। মদন বললেন, দেবী প্রথমে মায়াজালে আপনার মনোহর সাজসজ্জা আড়াল করে নেন, পথে অন্যের নজরে যেন না পড়েন। তারপর দুজনে মিলে ধ্যানমগ্ন শিবের কাছে উপস্থিত হলেন।
উমা দেবীর নির্দেশে মদন শিবের প্রতি ফুলশর নিক্ষেপ করলেন। শিবের ধ্যান ভেঙ্গে গেল। চোখের সামনে স্ত্রী পার্বতীকে দেখে শিব বললেন, আমি জানি তোমার আগমনের কারণ। রাবণের জন্য আমার বুক ফেটে যাচ্ছে কিন্তু অদৃষ্টকে কেউ লঙ্ঘন করতে পারে না। তিনি উমাকে বললেন, মদনকে মায়া দেবীর কাছে পাঠাতে। মায়া দেবীর সাহায্যে লক্ষ্মণ মেঘনাদকে বধ করবে।
মদন, দেবরাজ ইন্দ্রসহ মায়া দেবীর আলয়ে গেলেন। ইন্দ্র মায়া দেবীর কাছে জানতে চাইলেন কিভাবে লক্ষ্মণ মেঘনাদকে পরাজিত করতে পারবে। মায়া দেবী কিছুক্ষণ চিন্তা করে কার্তিক যে অস্ত্র দিয়ে তারকাসুরকে বধ করেছিলেন সে অস্ত্র দেখিয়ে বললেন- ‘এই অস্ত্রেই মেঘনাদ মারা যাবে কিন্তু ন্যায় যুদ্ধে তাকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। আমি কালই লঙ্কায় গিয়ে লক্ষ্মণকে রক্ষা করবো। তোমরা চলে যাও।’
ইন্দ্র-মদন অস্ত্র নিয়ে চলে আসলেন। দেবরাজ ইন্দ্র, গন্ধর্বরাজ চিত্ররথকে নিজের রথে করে অস্ত্র লক্ষ্মণের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। পাছে ইন্দ্রের রথে চিত্ররথকে দেখে রাক্ষসেরা গোল বাঁধায় তাই ইন্দ্র প্রবল ঝড়-বৃষ্টি সৃষ্টি করলেন যাতে রাক্ষসেরা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে গৃহে আশ্রয় নেয়। চিত্ররথ অস্ত্র নিয়ে রামের হাতে দিয়ে আসলেন। বললেন, কোন ভয় নেই। দেবতারা তার প্রতি প্রসন্ন। মায়া দেবী কাল লক্ষ্মণকে বলে দেবেন কিভাবে মেঘনাদকে হত্যা করতে হবে।
৩য় সর্গ: সমাগমো
স্বামীর বিরহে প্রমীলা প্রমোদ উদ্যানে কাতর। প্রমীলা সখী বাসন্তীকে প্রশ্ন করলেন কোথায় ইন্দ্রজিৎ(মেঘনাদ)? শীঘ্র আসছি বলে গেল আর এল না। বাসন্তী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে মালা গাঁথার জন্য ফুল তুলতে নিয়ে গেল। প্রমীলা বললেন এ মালা তো বৃথা। যাকে পরানোর সেতো কাছে নেই। বাসন্তী বলল কিভাবে লঙ্কায় প্রবেশ করবে? চারিদিকে রামের সৈন্য ঘিরে আছে। তখন প্রমীলা বললেন-
রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী,
আমি কি ডরাই সখি, ভিখারী রাঘবে?
পশিব লঙ্কায় আজি নিজ ভুজ বলে;
তখনই যোদ্ধার সাজে সেজে রাক্ষস নারীবাহিনী নিয়ে প্রমীলা লঙ্কায় প্রবেশের জন্য রওনা দিলেন। প্রমীলা তার দলবল নিয়ে পশ্চিম দুয়ারে এসে পৌঁছালে হনুমান তাকে বাধা দিলেন। হনুমান ভাবলেন এ বুঝি মায়া দেবীর ছলনা। লঙ্কায় এত নারী তিনি দেখেছেন কিন্তু এরূপ উগ্রচণ্ডী রূপী নারীতো কখনও দেখেননি।
প্রমীল বললেন, রামকে বল হয় আমাকে যেতে দিক নয়তো সাহস থাকলে এসে যুদ্ধ করুক।
শিবিরের বাইরে কোলাহল শুনে রাম জানতে চাইলেন কি হয়েছে। তখনই হনুমান প্রমীলার দূত সহ শিবিরে প্রবেশ করেন এবং রাবণ তাদের সঙ্গে অকারণে যুদ্ধ না করে নির্বিঘ্নে যাবার অনুমতি দেন।
প্রমীলা-দল চলে গেলে রাম অবাক হয়ে বিভীষণকে বলেন, একি স্বপ্ন নাকি কারও ছলনা? বিভীষণ বললেন, এই নারী কালনেমি দৈত্যের কন্যা প্রমীলা। মেঘনাদের স্ত্রী। রাক্ষস কূলে নারী পুরুষ সমান বীর দেখে রাম শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। লক্ষ্মণ ভাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, দেবতারা যার সহায় তার ভয় কিসের। অধর্ম সবসময় পরাজিত হয়। সত্যের জয় অনিবার্য।
বিভীষণ বললেন, এটা সত্য তবুও সতর্ক থাকা উচিত। রামের অনুরোধে বিভীষণ, সৈন্যরা কে কোথায় কেমন দায়িত্ব পালন করছে তা দেখতে চলে গেলেন।
ততক্ষণে প্রমীলা লঙ্কা নগরে পৌঁছে গেলেন। রাতের আঁধারে রাক্ষসেরা শত্রু মনে করে তাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলে তিনি তাদের নিবৃত করলেন। স্বামী-স্ত্রী সাক্ষাৎ হলে দুজনের মধ্যে কিছু ঠাট্টা মশকরা চলল। এরপর প্রমীলা ঘরে প্রবেশ করে যোদ্ধার বেশভুষা খুলে ফেললেন।
এদিকে বিভীষণ এবং লক্ষ্মণ উত্তর, পূর্ব এবং দক্ষিণ দুয়ার হয়ে পাহারারত সৈন্যদের অবস্থা দেখে সন্তুষ্ট মনে শিবিরে ফিরে আসলেন।
কৈলাসে উমা দেবী সখি বিজয়াকে প্রমীলাদের দৃশ্য দেখিয়ে বললেন সত্যযুগে দানব দমন করতে তিনিও এরূপ সেজে ছিলেন। বিজয়া বলল, ভেবে দেখেন দেবী কাল কিভাবে রামকে রক্ষা করবেন। উমা বললেন, কাল আমি প্রমীলার শক্তি হরণ করব, মেঘনাদকে লক্ষ্মণ বধ করবে। মৃত্যুর পরে স্বামী-স্ত্রী দুজনে এখানে আসবে। মেঘনাদ শিবের সেবা করবে। আমরা প্রমীলাকে সখি করে রাখব। এই বলে সকলে ঘুমাতে গেলেন।
৪র্থ সর্গ: অশোকবনং
কবি মধুসূদন কাব্য দেবীকে বন্দনা করছেন তাকে উত্তম কাব্য রচনা করার ক্ষমতা যেন দেন।
এদিকে লঙ্কান নগর ঘিরে চলছে মহা উৎসব, বইচে আনন্দের স্রোত। কেউ ঘুমাচ্ছে না। নিদ্রাদেবী দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে মরছে। তাকে কেউ প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। কারণ ভোর হলে মেঘনাদ রামকে মেরে আক্রমণকারীদের লঙ্কা থেকে তাড়িয়ে দেব।
শোকে আকুল সীতা একা অশোক বনে কাঁদছেন। এমন সময় সেখানে প্রহরী রাক্ষসীরা সব আনন্দে ব্যস্ত এই ফাঁকে বিভীষণের স্ত্রী সরমা সীতার সেবা করতে সেখানে আসলেন। কৌটা খুলে সীতার কপালে সিঁদুরের ফোঁটা দিলেন। বললেন দুষ্টু রাবণ এমন করে কিভাবে সীতার অলংকার খুলে নিতে পারল।
সীতা বললেন রাবণকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এই অলংকার আমি নিজে পথে পথে খুলে ফেলে দিয়েছি বলেই রাম আমাকে খুঁজতে খুঁজতে আজকে এখানে আসতে পেরেছে। সরমা সীতার কাছে তাকে কিভাবে রাবণ হরণ করলো তা শুনতে চাইলেন। সীতা সরমাকে বলতে লাগলেন- তারা গোদাবরী তীরে পঞ্চবটী বনে কী সুখে ছিলেন। যে কারণে ভুলে থাকতে পেরেছিলেন বনবাসের কষ্টের কথা। সীতার কথা শুনে সরমা বললেন, ইচ্ছে হচ্ছে রাজভোগ ছেড়ে আমিও বসবাসে যাই কিন্তু আমার তো সে গুণ নাই তোমার গুণেই বনবাসের কষ্টকর পরিবেশও সুখের হয়।
সীতা বলতে লাগলেন- একদিন সূর্পণখা আমাকে মেরে রামকে বিয়ে করতে চাইলে লক্ষ্মণের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ বাঁধল। ভয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। রাম এসে আমার জ্ঞান ফিরিয়েছিলেন। মারীচ কী ছলনা করেছিল তুমি তা শুনেছ। হঠাৎ দূরে কোথা হতে রামের আর্তনাদ শুনে জোর করে তাকে সাহায্য করতে লক্ষ্মণকে বনে পাঠিয়ে দিলাম। এদিকে বেলা বাড়তে লাগল। এমন সময় দেখি এক যোগী এসে খাবার ভিক্ষা চাইল। আমি রাম না আসা পর্যন্ত তাকে বাইরে বৃক্ষতলে অপেক্ষা করতে বললাম। সে ক্ষুধার্তকে খাবার না দিয়ে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছি বলে আমাকে ভর্ৎসনা করল। অভিশাপ দিতে চাইল। আমি ভয়ে ফলফলাদি নিয়ে বের হলে তোমার ভাসুর ছদ্মবেশ ত্যাগ করে আমাকে হরণ করল। আমি হাহাকার করলাম কিন্ত কেউ আমাকে বাঁচাতে এল না।
আমাকে হরণ করে রাবণ যখন আকাশ পথে নিয়ে আসছিল তখন হঠাৎ শুনি সিংহের গর্জন। দেখি এক ভীষণ মূর্তি। আকাশে তার সঙ্গে রাবণের ভয়ংকর যুদ্ধ বেঁধে গেল। আমি তখন মাটিতে। পালাতে চাইলাম কিন্তু আছাড় খেয়ে পড়ে অচেতন হয়ে গেলাম। স্বপ্নে দেখলাম, আমার মা বসুন্ধরা বলছেন বিধির ইচ্ছাতে রাবণ তোকে হরণ করেছে। তোর কারণে সবংশে সে বিনাশ হবে।’
স্বপ্নে একে একে সীতা দেখলেন বালীকে হত্যা করে সুগ্রীবকে সিংহাসনে বসানো, সুগ্রীবের সহায়তা নিয়ে রামের লঙ্কার উদ্দেশ্যে যুদ্ধযাত্রা। সাগরে সেতু তৈরি করে লঙ্কায় অবতরণ, রাবণের রাজসভায় বৈদেহীকে (সীতা) ফিরিয়ে দিতে বিভীষণের ভাইয়ের প্রতি অনুরোধ, রাবণ কর্তৃক বিভীষণকে তিরস্কার এবং বিভীষণের পক্ষ ত্যাগ।
এরপর রাক্ষসদের যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ, দলে দলে মাংশাসী প্রাণির আগমন, যুদ্ধে ক্রমে রাবণের শক্তিক্ষয়, কুম্ভকর্ণকে অকালে ঘুম থেকে জাগানো, রাম কর্তৃক কুম্ভকর্ণকে হত্যা করা, শেষে রাবণ নিহত হয়েছে বলে দেবকন্যাদের এসে সীতাকে নানান মূল্যবান বস্ত্রালংকারে সাজিয়ে দেয়া, সাজানো শেষে রামকে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধরতে গেলে স্বপ্ন ভেঙ্গে ঘুম থেকে জাগরণ- এসব সীতা সরমাকে বললেন। সরমা সীতাকে সান্ত্বনা দিলেন এ স্বপ্ন অবশ্যই সত্য হবে।
সীতা বললেন- যুদ্ধে জটায়ুকে নিহত করে রাবণ আবার আমাকে রথে তুলে লঙ্কাতে নিয়ে আসল। অসাধারণ সুন্দর লঙ্কা কিন্তু কারাগার যতই সুন্দর হোক কার বা ভাল লাগে?
সরমা সীতাকে সান্ত্বনা দিয়ে প্রহরী-দল ফিরে আসার আগে সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করলেন।
৫ম সর্গ: উদ্যোগো
স্বর্গে সবায় ঘুমাচ্ছে কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্রে চোখে ঘুম নেই। শচী ইন্দ্রকে বললেন, অস্ত্রতো রামের কাছে পাঠিয়েছেন এত চিন্তা কী? ভোর হয়ে আসছে এমন সময় মায়া দেবী ইন্দ্রের সামনে হাজির হলেন। ইন্দ্রকে বললেন, চিন্তার কিছু নেই আমি যাচ্ছি লঙ্কাপুরীতে লক্ষ্মণকে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে নিয়ে যাব। মায়াজালে বিভ্রান্ত করব মেঘনাদকে। সেখানেই সে নিহত হবে। কিন্তু এ সংবাদ যখন রাবণ পাবে তখন লক্ষ্মণের কি হবে?
ইন্দ্র বললেন আপনি আগে মেঘনাদকে মারেন তারপর আমি দেব সৈন্য দিয়ে লক্ষ্মণকে রক্ষা করতে কালই মর্ত্যে চলে যাব।
মায়া দেবীর নির্দেশে স্বপন-দেবী, লক্ষ্মরণের মা সুমিত্রার রূপ ধরে ঘুমের মধ্যে এসে লক্ষ্মণকে বলে দিলেন লঙ্কার বনের উত্তর পাশে সরোবরের তীরে চণ্ডী-মন্দিরে গিয়ে মায়ের (দূর্গা দেবী) পূজা করতে। রামের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে লক্ষ্মণ সেখানে চলে গেলেন। সেখানে স্বয়ং শিব পাহারা দেন। লক্ষ্মণ নিজের পরিচয় দিলে শিব তাকে পথ ছেড়ে দিলেন। মায়া-সিংহ ভয়ে পালিয়ে গেল। সরোবর তীরে এসে লক্ষ্মণ দেখলেন একদল স্বর্গের রমণী জলকেলি করছে। এসে তারা তাকে নানা প্রলোভনে ভোলাতে চাইল। তোমরা মাতৃতুল্য বলাতে তারা উধাও হয়ে গেল। লক্ষ্মণ স্নান করে নীল পদ্ম দিয়ে চণ্ডী দেবীর পূজা করলেন।
দেবী তাকে বর দিলেন এবং বলে দিলেন বিভীষণকে সঙ্গে নিয়ে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে গিয়ে মেঘনাদকে হত্যা করতে। অন্তরীক্ষ থেকেও তার জন্য আশীর্বাদ বর্ষিত হল।
এদিকে ভোরে মেঘনাদ জেগে উঠে প্রমীলাকে জাগালেন। দুজনে মিলে মন্দোদরীর কাছে গেলেন অনুমতি নিতে। ত্রিজটা রাক্ষসী এসে জানাল তিনি ঘরে নেই। রাণী শিবের মন্দিরে রাতভর মেঘনাদের কল্যাণ কামনায় শিবকে পূজো দিচ্ছেন। আশীর্বাদ নিতে সেখানে থেকে তারা দ্রুত মায়ের কাছে গেলেন। আশীর্বাদ করলেও মন্দোদরীর মনে ছেলের জন্য শঙ্কা জাগে। কারণ রামকে তার সাধারণ মানব বলে মনে হচ্ছে না অথবা দেবতারা সকলে তার সহায়। দুই দুইবার সে অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে, তার কথায় শিলা জলে ভাসে, বৃষ্টি হয়, আগুন নিভে যায়। মেঘনাদ তার মাকে সান্ত্বনা দিয়ে প্রমীলাকে মন্দোদরীর কাছে রেখে একাকী যজ্ঞ করতে রওনা দিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে নুপুর ধ্বনি শুনে পিছনে দেখলেন তার স্ত্রী প্রমীলার আগমন। মেঘনাদ তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলেন। স্বামীকে বিদায় দিয়ে প্রমিলা হাহাকার করতে করতে ঘরে চলে যায়। অশুচি হয়ে মেঘনাদ নিকুম্ভিলা যজ্ঞ করতে যাত্রা করলেন।
৬ষ্ঠ সর্গ: বধো
দেবী চণ্ডীকে পূজা শেষে লক্ষ্মণ রামের শিবিরে গিয়ে কি কি ঘটনা ঘটেছিল রামকে সব বলে যুদ্ধে যাবার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু রামের মনে তখনও শঙ্কা, বলছেন-
কেমনে পাঠাই তোরে সে সর্পবিবরে,
প্রাণাধিক? ‘নাহি কাজ সীতায় উদ্ধারি।
তখন লক্ষ্মণ বলে দৈব আজ্ঞা অমান্য করা উচিত নয়। বিভীষণও বললেন যে, স্বপ্নে দেবী লক্ষ্মী তাকে একই কথা বলেছেন। সুতরাং ভয়ের কিছু নেই। রাম বললেন, ‘দাসী মন্থরার কুমন্ত্রণায় সৎ মা কৈকেয়ী ইচ্ছা পূরণ করতে পিত্রসত্য রক্ষার জন্য বনবাসে আসার সময় এই লক্ষ্মণ; পিতা-মাতা, প্রিয় স্ত্রী উর্মিলাকে এবং রাজ-সুখ-স্বচ্ছন্দ্য সব বিসর্জন দিয়ে আমার সঙ্গে এসেছে, আসার সময় মাতা সুমিত্রা একে আমার হাতেই সঁপে দিয়েছিলেন সুতরাং তাকে আমি হারাতে পারবো না। কারণ যাকে আমার সমস্ত যোদ্ধারা মিলে পরাস্ত করতে পারবে না তাকে একা লক্ষ্মণ কিভাবে পরাজিত করবে?’
তখন আকাশ থেকে দেবী সরস্বতী দৈববাণীকে অমান্য করতে নিষেধ করলেন। দৈববাণীর সঙ্গে সঙ্গে আকাশে দৈবলীলা দেখে রাম লক্ষ্মণকে যোদ্ধা সাজে সাজিয়ে যুদ্ধে পাঠিয়ে দিলেন। মায়ার প্রভাবে লক্ষ্মণ এবং বিভীষণ লঙ্কার উদ্দেশ্যে চললেন অদৃশ্যভাবে।
মায়া দেবী লঙ্কায় রাক্ষস নারীর ছদ্মবেশে কমলা দেবীর মন্দিরে আসলেন, লক্ষ্মণের জন্য আশীর্বাদ চাইতে। কমলা, মায়া দেবীকে অভয় দিলেন। দুজনে চললেন পশ্চিম দুয়ারের দিকে। প্রাচীরে উঠে দেখলেন কুয়াশা আবৃত লক্ষ্মণ ও বিভীষণকে। বিষাদে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মায়া দেবীকে বিদায় দিয়ে সেখান থেকে কমলা মন্দিরে চলে গেলেন।
অদৃশ্য হয়ে বিভীষণ এবং লক্ষ্মণ লঙ্কায় প্রবেশ করলেন। চারিদিকে দেখলেন রাক্ষস বীর যোদ্ধাদের। যারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। দেখলেন নগরের মাঝখানে রাবণের অসাধারণ সুন্দর রাজপ্রাসাদ। মায়া দেবীর সহায়তায় অদৃশ্য হয়ে চলতে চলতে লক্ষ্মণ সরোবরে কলসি কাঁখে দেখলেন রাক্ষস রমনীদেরসহ লঙ্কার আরও নানান দৃশ্য।
যজ্ঞাগারে মেঘনাদ নিকুম্ভিলা যজ্ঞ করার সময় সেখানে লক্ষ্মণ এবং বিভীষণ প্রবেশ করলেন। মেঘনাদ দেখে মনে করলেন শিব বুঝি সামনে এসে উপস্থিত হয়েছেন। লক্ষ্মণ তার পরিচয় দিলে মেঘনাদ অবাক হয়ে গেলেন, কিভাবে সম্ভব এত কঠোর পাহারা ভেদ করে লঙ্কায় ভেতরে চলে আসা।
লক্ষ্মণ মেঘনাদকে যুদ্ধে আহবান করলেন। মেঘনাদ অস্ত্রে সজ্জিত হতে চাইলে লক্ষণ বললেন, ‘ফাঁদে পড়লে শিকারী কি বাঘকে ছেড়ে দেয়? সুতরাং এখনি তোকে হত্যা করবো।’
মেঘনাদের আঘাতে লক্ষ্মণ পড়ে গেলেন। তিনি দৈব অস্ত্র (তলোয়ার) ঢাল ইত্যাদি তুলতে চাইলেন কিন্তু কোনটা তুলতে পারলেন না। দুয়ার খুলতে চাইলেন। তখন দুয়ারে দেখতে পেলেন চাচা বিভীষণকে। দেখে মেঘনাদ চাচাকে অনেক তিরস্কার করলেন। অস্ত্রাগারে যাওয়ার জন্য পথ ছেড়ে দিতে বললেন কিন্তু বিভীষণ পথ ছাড়লেন না। লক্ষ্মণ চেতনা ফিরে পেয়ে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালেন। দৈব অস্ত্র দিয়ে মেঘনাদকে তীর বিদ্ধ করলেন। মেঘনাদের সমন্ত শরীর-বস্ত্র রক্তে ভেসে গেল। অসহ্য ব্যথায় একে একে সামনে যা পেলেন তাই লক্ষ্মণের দিকে ছুড়ে মারলেন। কিন্তু মায়া দেবী দৈববলে সব কিছু প্রতিহত করে দিলেন। ইন্দ্রজিৎ সজোরে আক্রমণ করতে লক্ষ্মণের দিকে ধেয়ে গেলেন। লক্ষ্মণ তালোয়ার বের করে মেঘনাদকে হত্যা করলেন। বসুন্ধরা কেঁপে উঠল, রাবণের মাথা থেকে মুকুট খসে পড়ল, সাগরে মহাগর্জন উঠল, মহাবিলাপে পৃথিবী ভরে গেল। স্বর্গ, মর্ত্য, পাতালে জীব সকল আতঙ্কে কেঁপে উঠল, প্রমীলার ডান চোখ নেচে উঠল, আনমনে অজান্তে সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেললেন, মন্দোদরী মূর্ছা গেলেন। মায়ের কোলে শিশুরা ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠল।
মেঘনাদ মারা গেলে বিভীষণ ভ্রাতুষ্পত্রের জন্য শোকে কিছুক্ষণ বিলাপ করে সহসা তারা সেখান থেকে শিবিরে ফিরে আসলেন। তাদের পেয়ে রাম ভাইকে জড়িয়ে ধরলেন। বিভীষণকেও প্রশংসা করলেন। চারিদিকে রামের জয়ধ্বনি শুনে আতঙ্কে লঙ্কা জেগে উঠল।
৭ম সর্গ: শক্তিনির্ভেদো
ভোর হলে বারুণী দেবী সখি বাসন্তীকে বললেন, অলংকার পরতে পারছি না, লঙ্কার চারদিকে কান্না শুনা যাচ্ছে। ডান চোখ নাচছে, সখি যাও যজ্ঞাগারে মেঘনাদকে বল আজ যুদ্ধে না যেতে। এই বলে দুজনেই লঙ্কার পানে চলে গেলেন।
এদিকে কৈলাসে বিষাদ মুখে শিব উমাকে বলছেন, তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে, মেঘনাদ নিহত হয়েছে। কিন্তু আমি যদি প্রিয় ভক্ত রাবণকে না বাঁচাই তাহলে সে নির্বংশ হবে। উমা বললেন, যা ইচ্ছা করেন কিন্তু উমার ভক্ত রামের কথাও যেন মনে থাকে।
তখন শিব তার সহচর বীরভদ্রকে স্মরণ করলেন। বীরভদ্র উপস্থিত হলে মেঘনাদকে হত্যার সংবাদ দিতে রাবণের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কারণ এ সংবাদ কোন রাক্ষসের পক্ষে রাবণকে দেয়া সম্ভব হবে না। রাবণকে প্রণাম করে বীরভদ্র অশ্রুসিক্ত চোখে দাঁড়ালেন। রাবণের অভয় পেয়ে মেঘনাদের মৃত্যু সংবাদ দিলেন। শুনে রাবণ অচেতন হয়ে গেলেন, সভাসদরা হাহাকার করে উঠল। সংবাদ দিয়ে দূত অদৃশ্য হয়ে গেলে রাবণ শিবকে দেখতে পেলেন।
রাবণ সৈন্যদের যুদ্ধসাজ গ্রহণ করতে আদেশ দিলেন।
দেবী চণ্ডী নিজেও যুদ্ধসাজ গ্রহণ করলেন।
এদিকে পৃথিবী তর থর করে কেঁপে উঠল। রাম বিভীষণের কাছে কারণ জানতে চাইলেন। বিভীষণ বললেন, এ ভূ-কম্পন নয়, রাক্ষস সৈন্যরা যুদ্ধসাজ গ্রহণ করছে।
রাম সৈন্যদের ডেকে আনতে বললেন। একে একে জড়ো হল সুগ্রীব, অঙ্গদ, নল, হনুমানসহ অন্যান্য সব বীর। রাম সকলকে রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আহবান করলেন। সুগ্রীব রামকে অভয় দিলেন।
কমলা দেবী স্বর্গে ইন্দ্রের কাছে গেলেন যুদ্ধে কিভাবে রাবণের হাত থেকে লক্ষ্মণকে রক্ষা করা যায় তার পরামর্শ চাইতে। দেবী স্বর্গের উত্তর ভাগে দেখলেন প্রস্তুত দেব সৈন্য। ইন্দ্রকে আশীর্বাদ করে দেবী লঙ্কায় ফিরে আসলেন। কিন্তু রাবণের জন্য তার মন দুঃখভারাক্রান্ত।
রানি মন্দোদরী এসে রাবণের পদে লুটিয়ে পড়লেন। রাবণ তাকে ঘরে ফিরে যেতে বললেন। তিনি ছেলে হত্যার প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধে যাবেন। মন্দোদরী যেন তাকে বাধা না দেন। শোক-দুঃখ ত্যাগ করে রাবণ সকলকে যুদ্ধে আহবান করলেন।
ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে এই ভয়ে আকুলা পৃথিবী (বসুন্ধরা) স্বর্গে নারায়ণের কাছে গেলেন। নারায়ণ তাকে শিবের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কারণ তিনি ভয়ংকর শক্তি দান করে রাবণকে শক্তিশালী করেছেন।
শিব বসুন্ধরাকে(পৃথিবী) বললেন, ‘তুমি ফিরে যাও। আমি দেবশক্তি হরণ করব। ইন্দ্র আজ লক্ষ্মণকে রক্ষা করতে পারবে না। ’ শিব গড়ুরকে নির্দেশ দিলেন আকাশে উড়ে দেবতেজ হরণ করতে। গড়ুর আকাশে উড়ে পাখা বিস্তার করলে ছায়ায় পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে আসল। রাক্ষস সৈন্য বের হয়ে আসল। গর্জে উঠল রাম-সৈন্য। যুদ্ধে প্রবেশ করল দেব-সৈন্য। ইন্দ্রের আদেশে রাম যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন।
সারথীকে সম্বোধন করে রাবণ বললেন, ‘চেয়ে দেখ রাম-সৈন্যের ভেতর মিশে দেবসৈন্য যুদ্ধ করছে।’ রাবণ রথ নিয়ে শত্রুসৈন্যের ভিতর প্রবেশ করে দেবতা কার্তিককে দেখে কৈফিয়ত চাইলেন, তারা কেন আজ রামের পক্ষে যুদ্ধ করছে। কার্তিক বললেন, দেবরাজ ইন্দ্রের ইচ্ছায় আজকে লক্ষ্মণকে রক্ষার জন্য তিনি যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। কার্তিকের সঙ্গে রাবণের ঘোর যুদ্ধ বেঁধে গেল। যুদ্ধ অনুকূলে নয় দেখে উমার প্রেরিত দূতের সংবাদে কার্তিক অস্ত্র ত্যাগ করলেন। রাবণ তখনই ইন্দ্রকে আক্রমণ করে বসলেন। ইন্দ্রের দৈবশক্তি কাজ করছে না। এমন সময় রাম সেখানে আসলেন।
রাবণ রামকে দেখে বললেন, ‘তুমি আর একদিনের জন্য জীবন পেলে। আজ তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করার ইচ্ছা আমার নেই। কোথায় তোমার ভাই। তাকেই মারব। তুমি শিবিরে ফিরে যাও।’
দূরে লক্ষ্মণকে দেখে রাবণ তার দিকে ধাবিত হলে দেব-মনুষ্য সৈন্য লক্ষ্মণকে রক্ষা করার জন্য জড়ো হলো। রাবণকে বাঁধা দিল বিড়ালাক্ষ, হনুমান। হনুমান পরাস্ত হয়ে যুদ্ধ থেকে পালিয়ে গেলেন।
এরপরে সুগ্রীব আসলেন কিন্তু তিনিও রাবণের আঘাতে টিকতে না পেরে পালিয়ে গেলেন। তখন রাবণ লক্ষ্মণকে দেখতে পেলেন। রাবণ এবং লক্ষ্মণের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ বেঁধে গেল। রাবণের আঘাতে লক্ষ্মণ মাটিতে পড়ে গেলেন। রাবণ রথ থেকে নেমে তাকে ধরতে গেলে চারিদিকে হাহাকার উঠল। কৈলাসে উমা দেবী শিবের কাছে লক্ষ্মণকে রক্ষার প্রার্থনা করলেন। শিবের আদেশে বীরভদ্র রাবণের কানে কানে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করতে বলল। রাবণ যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে চলে গেলেন। দেবতার দল মিলে উমা দেবীকে বন্দনা করল।
৮ম সর্গ: প্রেতপুরী
রাবণের আঘাতে হতচেতন অবস্থায় লক্ষ্মণ পড়ে আছে। রামের সঙ্গে সবাই দুঃখে কাতর। রাম ভাইকে হারাতে হবে এই ভয়ে বিলাপ করছেন। কৈলাসে লক্ষ্মণের জন্য উমা দেবী বিলাপ করে করে রাবণকে রক্ষা করায় শিবকে ভর্ৎসনা করছেন। তখন শিব বলে দিলেন রাম যেন মায়া দেবীর সাহায্যে প্রেতপুরীতে গিয়ে দশরথের সঙ্গে দেখা করে তিনিই বলে দিবেন কিভাবে লক্ষ্মণ বেঁচে উঠবে। উমার আদেশে মায়া দেবী লঙ্কায় রামের কাছে চলে গেলেন। সাগর জলে স্নান করে মায়া দেবীর সঙ্গে রাম চললেন যমালয়ে।
যমালয়ে প্রবেশ করে রাম দেখলেন চির অন্ধকারময় প্রেতপুরীর ভয়ঙ্কর রূপ। বৈতরণী নদী গর্জন তুলে বয়ে চলেছে। তার উপরে “কামরূপী” সেতু ক্ষণে সুন্দর শোভিত, ক্ষণে অগ্নিময় তেজে জ্বলন্ত। সেতু এমন করছে কেন, রামের এ প্রশ্নের জবাবে মায়া দেবী বললেন সেতু পাপীদের জন্য অগ্নিময় আর পূণ্যবান আসলে সুন্দর সুশোভিত হয়। মায়া দেবী বললেন, উত্তর আর পশ্চিম পথে যায় ধার্মীকেরা।
বৈতরণী নদী পার হয়ে তারা দে লেন লৌহ দরজা, তাতে অগ্নিঅক্ষরে লেখা আছে- এ পথে পাপীদের যেতে হয়। সেখানে পাপীরা তাদের পাপের ফল দুঃখ যাতনা ভোগ করছে। দক্ষিণ দুয়ারে দেখলেন চৌরাশি নরকের কালাগ্নি ভরা রৌরব মহাহ্রদ। সেখানে কোটি কোটি প্রাণী হাহাকার করে ছটফটিয়ে ভাসছে। দেখছেন মারীচ, খর সহ বিভিন্ন জনকে। দেখলেন কামমত্ত নারী-পুরুষদের শাস্তি। মায়া দেবী বললেন এক নাগারে বার বছর দেখলেও এর দেখা শেষ হবে না।
পূর্বদ্বারে সতী-সাধ্বী নারীদের সুখ দেখে তারা গেলেন উত্তর দিকে। কঠিন নরক পাড় হয়ে তারা পৌঁছালেন সেই কাঙ্ক্ষিত স্থানে, যেখানে সত্যযুগে যুদ্ধে নিহতরা থাকে। সেখানে অনেককে দেখলেও রাম কুম্ভকর্ণ, মেঘনাদ এদের দেখতে পেলেন না। কেন, জানতে চাইলে মায়া দেবী বললেন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ব্যতীত সেখানে আসার উপায় নেই। সেখানে বালীর সঙ্গে রামের দেখা হল। বালী তাকে জটায়ুর সঙ্গে দেখা করাল। জটায়ু রামকে পশ্চিম দুয়ারে দশরথের কাছে নিয়ে গেল। সেখানে রামের সঙ্গে তার পূর্বপুরুষ দিলীপ-সুদক্ষিণা দম্পতির দেখা হল। রাম তার বংশ পরিচয় দিলেন। পূর্বপুরুষের আশীর্বাদ নিয়ে জটায়ুকে বিদায় দিয়ে সেখান থেকে রাম একাকী চললেন।
দশরথের সঙ্গে রামের দেখা হল দশরথ বলে দিলেন কিভাবে লক্ষ্মণ বাঁচবে। গন্ধমাদন পর্বতের শীর্ষে পাওয়া যায় মহৌষধ বিশল্যকরণী ও হেমলতা। রাত থাকতে থাকতে হনুমানকে দিয়ে দ্রুত সে ঔষধ আনাতে হবে। রাম পিতাকে প্রণাম জানিয়ে লঙ্কায় ফিরে এলেন।
৯ম সর্গ: সংস্ক্রিয়া
লঙ্কায় ভোর হল। রাবণ প্রধানমন্ত্রী সারণকে জিজ্ঞাসা করলেন শত্রুদল এত আনন্দ উল্লাস করছে কেন? মন্ত্রী জানালনে দবৈ বলে লক্ষ্মণ প্রাণ ফরিে পয়েছেে তাই। শুনে রাবণ র্দীঘশ্বাস ছাড়লনে। বলিাপ করতে করতে সারণকে সাত দনিরে যুদ্ধবরিতি চয়েে রামরে কাছে পাঠালনে যাতে মৃত সন্তানরে অন্ত্যষ্টেক্রিয়িা করতে পারনে। তার ধারণা হল বধিি বাম বলইে শক্তশিালী হয়ওে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছনে। সারণ সসন্যৈে রামরে শবিরিে গলেনে। শবিরিে রাম বসে আছনে। সম্মুখে লক্ষ্মণ, ডানপাশে বিভীষণ অন্য বীরেরা চারিদিকে তাকে ঘিরে আছে। রামের দূত এসে মন্ত্রী সারণের আসার সংবাদ দিল।
রাম তার কাছে সারণকে নিয়ে আসতে আদেশ দিলেন। সারণ রাবণের সাত দিনের অস্ত্রবিরতি চাওয়ার কথা রামকে জানাল। রাম রাবণের প্রস্তাব মেনে নিয়ে অভয় দিয়ে সারণকে পাঠিয়ে নিলেন। যথারীতি সারণ সংবাদটা রাবণকে দিলে রাবণ তার সৈন্যদের যুদ্ধসাজ ত্যাগের আদেশ দিলেন।
এদিকে অশোকবনে রাক্ষস বধূ বেশে বিভীষণের স্ত্রী সরমা প্রবেশ করলে সীতা তার কাছে যুদ্ধের সংবাদ জানতে চাইলেন। তিনি গত কদিন ধরে চারিদিকে বিলাপ শুনছেন। রাক্ষস নারী-পাহারাদারদের কাছে তিনি এ বিষয়ে জানতে চান না কারণ আগের রাত্রে ভয়ংকর দর্শন এক রাক্ষসী তাকে মেরে ফেলার জন্য তেড়ে এসেছিল অন্য আরেকজন বাধা দেয়াতে তিনি বেঁচে গেছেন।
সরমা জানালেন যে, ইন্দ্রজিৎ (মেঘনাদ) লক্ষ্মণের হাতে নিহত হয়েছে। যে কারণে রাক্ষরা রাত-দিন বিলাপ করছে। কাঁদছে মন্দোদরী।
সীতা শ্বাশুড়ী সুমিত্রাকে ধন্যবাদ দিলেন এমন বীর পুত্র গর্ভে ধরেছেন বলে। সরমা আরও জানালেন মেঘনাদকে দাহ করতে নিয়ে যাওয়া হবে। তার স্ত্রী প্রমীলা সহমৃতা হবেন।
প্রমীলার কথা শুনে সীতা মনে কষ্ট পেলেন। তিনি সবকিছুর জন্য নিজেকে দোষী বললেন। সরমা বললেন- না, সবকিছুর জন্য রাবণ দায়ী।
বজ্রের শব্দে পশ্চিমের দুয়ার খুলে গেল। শত সহস্র রাক্ষস স্বর্ণদণ্ড হাতে বের হল। তাতে উজ্জ্বল পতাকা উড়ছে। সর্বাগ্রে বাদকদল দুন্দভি বাজিয়ে চলেছে। পিছে পদাতিক। তারপর অশ্বারোহী, রথী এভাবে তারা নিরানন্দে সাগরের দিকে চলেছে।
তারপরে বের হলো প্রমীলা অপরূপ যুদ্ধ সাজে। তাকে দেখে রাক্ষস নারীদের কেহ আবেগ তাড়িত, কেহ কান্না করছে, কেহ রাগে আগুন চোখে রামের সৈন্যবাহিনীর দিকে তাকাচ্ছে আর কান্না করতে করতে তার সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে চলেছে। ফুলে আবৃত মেঘনাদের শবের পাশে প্রমীলা।
রাবণ পায়ে হেঁটে বেরিয়ে এলেন। চোখ অশ্রুপূর্ণ। চারিদিকে নতভাবে মন্ত্রীদল। পিছনে লঙ্কাবাসী কাঁদতে কাঁদতে বের হল।
রাম অঙ্গদকে আদেশ দিলেন দশ শত রথী নিয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে। আসলেন দেবরাজ ইন্দ্র, সঙ্গে স্ত্রী শচীদেবী, চিত্ররথ, পবন দেব, যক্ষ সহ অনেক দেবতা। আর আসলেন গন্ধর্ব, অপ্সরা, কিন্নর, কিন্নরী সহ অনেকে। সাগর তীরে চন্দন কাঠ দিয়ে চিতা রচিত হল, ঢালা হল ঘৃত। মন্দাকিনীর পবিত্র জলে শব দেহগুলোকে গোসল করিয়ে কৌষিক বস্ত্র পরিধান করিয়ে দাহস্থানে রাখা হল। অঙ্গের মূল্যবান রতœ আভরণ খুলে প্রমীলা চিতায় উঠে স্বামীর পদতলে বসে গেলেন।
রাবণ সামনে এসে কাতর স্বরে বিলাপ করতে লাগলেন, হা পুত্র! আশা করেছিলাম তোমার মুখ দেখতে দেখতে চোখ বুজব, তোমাকে রাজ্যভার দিয়ে করব অন্তিমযাত্রা। কিন্তু বিধি বাম। কী লাভ হল এত যত্ন করে শিবের সেবা করে? শূন্য লঙ্কায় কী করে ফিরব? কি জবাব দেব মন্দোদরীকে? কী পাপে বিধাতা রাবণকে এমন যাতনা দিলে?
রাবণের এমন হাকাহার আর আর্তনাদে কৈলাসে শিব অধীর হয়ে উঠলেন। নড়ে উঠল তার জটা, সাপেরা গর্জে উঠল, জ্বলে উঠল আগুন, ভৈরব কল্লোলে কল্লোলিত হল গঙ্গা। কৈলাস পর্বত থরথর করে কেঁপে উঠল, আতঙ্কে কেঁপে উঠল পৃথিবী। উমা দেবী ভয়ে পেয়ে শিবকে পায়ে ধরে বললেন, প্রভু রাগান্বিত কেন? বিধির ইচ্ছায় রাবণের পতন হয়েছে, রামের কোন দোষ নেই। তবু যদি রামকে বিনাশ করেন তাহলে আগে আমাকে ভস্ম করে দেন।
উমা দেবীকে তুলে ধরে শিব রাবণের প্রতি গভীর স্নেহের কারণে তার হৃদয়ের রক্তক্ষরণের কথা বললেন। অগ্নিদেবকে আদেশ দিলেন দ্রুত চিতা প্রজ্জ্বলিত করে স্ত্রী সহ মেঘনাদকে কৈলাসে নিয়ে আসতে।
অগ্নিদেব পৃথিবীতে গমন করে চিতা জ¦ালিয়ে দিলেন। সকলে দেখল আগুনের মধ্যে একটা আগ্নেয় রথ, তাতে বসা মেঘনাদ তার বাম পাশে প্রমীলা। রথ আকাশে উড়ে গেল। দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করলেন। একই সঙ্গে আনন্দ এবং বিষাদে পৃথিবী ভরে গেল। রাক্ষসেরা দুধ দিয়ে চিতা নিভিয়ে সাগর জলে চিতাভস্ম ভাসিয়ে দিল। জাহ্নবীর জলে ধুয়ে চিতাস্থলে স্বর্ণের পাত দিয়ে সৌধ নির্মাণ করা হল।
সাগর জলে স্নান করে রাক্ষসেরা লঙ্কায় ফিরে গেল। যেন দশমীর দিনে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে সাত দিন ধরে সমগ্র লঙ্কা বিষাদে কাঁদল।
---০---
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন