বাংলা ভাষা উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ
বাংলা ভাষা উৎস বা উৎপত্তির
বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে তিনটি মতবাদ প্রচলিত আছে।
১ম
মতবাদ: বাংলা সংস্কৃতের দুহিতা
এই মতবাদের প্রথম প্রবক্তা
ঠিক যে কে এটা বলার কোন উপায় নেই। সম্ভবত ঊনিশ শতকে বাংলা সাহিত্য যখন আধুনিক যুগে
প্রবেশ করে তখন গদ্যচর্চা করতে গিয়ে সংস্কৃত পণ্ডিতদের মধ্য থেকে এই মতবাদের উৎপত্তি
লাভ হয়। হয়তো বাংলা ভাষার প্রচুর সংস্কৃত শব্দের উপস্থিতি তাদের এ কথা বলার সুযোগ করে
দিয়েছিল। তাছাড়া তারা যেহেতু সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন এবং ধর্মে ব্রাহ্মণ ফলে এতে
তারা বাংলাকে সংস্কৃতের কন্যা বলে স্বস্তি লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে এই মতবাদ সর্বতোভাবে
ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়।
এ প্রসঙ্গে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
মহামহোপাধ্যায় মহাশয় অষ্টম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে সাহিত্য শাখার সভাপতির ভাষণে যথার্থ
বলেছেন-’’বাংলা সংস্কৃতের কন্যা তো নয়ই বরং সংস্কৃত বাংলার অতি-অতি-অতি-অতি-অতিবৃদ্ধ
প্রপিতামহী”। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং সুকুমার সেন প্রমুখ পণ্ডিতেরা দেখিয়েছেন
সংস্কৃতের কোন উত্তরসূরী নেই। পাণিনি কর্তৃক সংস্কৃত ভাষাকে বিধিবদ্ধ করার পরপরই সেটি
মৃত ভাষায় পরিণত হয়।
ভাষার টিকুজী আলোচনায় আমরা
দেখতে পাই, সংস্কৃতের সমসাময়িক প্রাকৃত এবং পরবর্তীতে অপভ্রংশ বলে ভাষার আরও একটি স্তর
রয়েছে। তারপর থেকেই শুরু হয় ভাষার প্রাচীনযুগ, মধ্যযুগ এবংআধুনিকযুগ। সুতরাং বাংলার
সাথে সংস্কৃতের সরাসরি যোগের কোন সুযোগ নেই।
অন্যদিকে সংস্কৃত সাধারণ জনগণের
ভাষা ছিল না। সংস্কৃত ছিল শিষ্ট বা ব্রাহ্মণ্য সমাজে প্রচলিত সাহিত্যিক ভাষা। সেই সময়ে
সংস্কৃতের পাশাপাশি প্রচলিত প্রাকৃত ভাষাগুলোই ছিল সাধারণ জনগণের ভাষা এবং বাংলা সহ
অন্যান্য ভারতীয় ভাষাগুলোর উৎপত্তি হয়েছে এই প্রাকৃত ভাষাগুলো থেকে।
এক্ষেত্রে আমরা ড. মুহম্মদ
শহীদুল্লাহর ”বাঙ্গালা ভাষার ইতবৃত্ত” বইটির ব্যাখ্যাকে উল্লেখ করতে পারি। তিনি প্রচলিত
কয়েকটি শব্দের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন শব্দগুলো সরাসরি সংস্কৃত থেকে আসেনি। যেমন-
বাংলা সংস্কৃত প্রাকৃত
আমি অস্মদ অম্মে
তুমি যুস্মদ তুষ্মে
মা মাতা মাঅ
বাবা পিতা বপ্প
বোন ভগিনী বহিনী
হাত হস্ত হত্থ
পা পদ পাঅ
নাক নাসিকা নক্ক
গরু গো গোরুঅ
গাছ বৃক্ক গচ্ছ
দেখে পশ্যতি
দেকখই
এখানে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে
যে শব্দগুলো সরাসরি সংস্কৃত থেকে আসেনি প্রাকৃত ভাষা থেকে অপভ্রংশের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত
হয়ে বাংলায় এসেছে।
বাক্যের ক্ষেত্রে দেখা যায়-
বাংলা – তুমি আছ
সংস্কৃত- যুয়ং স্থ
প্রাচীন প্রাকৃতে(পালি)- তুমহে
অচ্ছথ
মধ্য প্রাকৃতে বা অপভ্রংশে-
তুমহে অচ্ছহ
প্রাচীন বাংলা-তুমহে আছহ
মধ্য বাংলা- তুহ্মি বা তোহ্মে
আছহ
আধুনিক বাংলা- তুমি আছ।
সুতরাং ধ্বনিতাত্ত্বিক এবং
রূপতাত্ত্বিক উভয় বিচারে আমরা দেখতে পাই যে বাংলা সংস্কৃত থেকে নয় প্রাকৃত ভাষা থেকে
অপভ্রংশের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়ে বর্তমান অবস্থা লাভ করেছে।
২য়
মতবাদ: বাংলা ভাষা মাগধী প্রাকৃত থেকে উৎপন্ন হয়েছে
এই মতবাদের প্রবক্তা জর্জ আব্রাহাম
গ্রীয়ারসন। পরবর্তীতে তার ছাত্র ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এই মতটিকে তার ১৯২৬ সালে
প্রকাশিত PhD থিসিস Origin and Development of Bengali Language (ODBL) গ্রন্থে এই
মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
তারা বলেন বাংলা, বিহারী, ভোজপুরী,
ওড়িয়া বা উড়িয়া, আসামী বা অহমীয়া এইু ভাষাগুলো একই উৎস থেকে উৎপন্ন হয়েছে। অর্থাৎ তারা
সহোদর স্থানীয়া। কারণ-
১। বাংলায় কেবল একটি মাত্র
শ (শ-কার) আছে (আস্তে, কাস্তে এ কয়টি শব্দ ছাড়া)। যদিও বানানে তিনটি শ, ষ, স দেখা যায়।
সে, আঁশ(আমিষ শব্দ জাত), আঁশ( অংশু শব্দ জাত) এই তি জায়গাতেই কেবল “শ” উচ্চারিত হয়।
তেমনি- “সবিশেষ” শব্দে তিনটি স, শ, ষ থাকলেও কেবল একটি শ-ই (তালব্য-শ) উচ্চারিত হয়।
মাগধী প্রাকৃতেও এই লক্ষণ দেখা যায়।
২। মাগধী প্রাকৃতে কর্তায় এ-কার
হয়। বাংলাতেও কোথাও কোথাও এই লক্ষণ দেখা যায়। যেমন- পাগলে কি না বলে ছাগলে কি না খায়।
৩। বাংলার ”মড়া” শব্দ মাগধী
প্রাকতের ”মড়” হতে আসতে পারে।
মূলত এ কারণগুলিকেই মাগধী প্রাকৃত
থেকে বাংলা ও তার সহোদরা ভাষাগুলির উৎপন্ন হবার কারণ বলে মনে করা হয়।
এর বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন
করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, মাগধী প্রাকৃতে যেমন তিনটি (শ, ষ, স) উষ্মবর্ণের(বাংলায় উষ্মবর্ণ চারটি- শ, ষ, স এবং হ)
স্থলে একটি মাত্র “শ”-কার হয় তেমনি ”র” স্থানে
”ল” হয়। যেমন- হেমচন্দ্রের ব্যাকরণের সূত্র (৮।৪।২৮৮) “রসো র্লশৌ”। বাংলা সহ সহোদরা
অন্য ভাষাগুলিতে এই দুটি পরিবর্তন এক সাথে দেখা যায় না। বাংলায় “র” থেকে “ল”-এর পরিবর্তন
দুএকটি জায়গায় দেখা গেলেও তা অন্যভাবেও আসতে পারে। যেমন- বাংলা শব্দ হলুদ/হলদি, প্রাকৃতে
হলদ্দী, প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষায় (সংস্কৃত) হরিদ্রা।
সুতরাং শুধু “শ”-কারত্বের একটি
বৈশিষ্ট্য দেখে বাংলা মাগধী প্রাকৃত থেকে উৎপন্ন এ কথা বলা যায় না। কারণ বাংলার “শ”-কারত্ব
মূল প্রাচ্য কথ্য অপভ্রংশের সমকালীন নয়, অনেক পরে উৎপন্ন বৈশিষ্ট্য। যেমন পূর্ববঙ্গের
অনেক উপভাষায় এবং আসামের শ, ষ, স স্থলে “হ”-কার অনেক পরবর্তী ধ্বনি পরিবর্তন।
সমকালীন হলে বাংলারসেহোদরা
ভাষাগুলিতেও শ-কারত্ব দেখা যেত। কিন্তু উড়িয়া ও বিহারীতে স-কার এবং আসামী ভাষায় হ-কার
দেখা যায়। বাংলার পশ্চিম প্রান্তের ভাষায়ও দন্ত্য-স প্রচলিত আছে। বাংলার বাইরে হিন্দি,
নেপালি, গুজরাটি, সিন্ধি, পাঞ্জাবি ইত্যাতদ ভাষাতেও শ, ষ, স এই তিনটির মধ্যে কেবল দন্ত্য-স
হয়।
শৌরসেনী মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতেও
দন্ত্য-স ছিল। অশোকের অনুশাসন লিপি এবং পালিতে এই স-কারের অস্তিত্ব প্রাচীন প্রাচ্য
প্রাকৃতে স-ধ্বনি থাকার বিষয়টিকে প্রমাণ করে। অশোকের পূর্বদেশীয় অনুশাসন লিপিগুলোতে
ল-কার নেই। শ-কার এবং ল-কার উভয় কেবল রামগড়ের সতুনকা লিপিতে দেখা যায়।
কর্তৃকারকের এ বিভক্তি মাগধী
প্রাকৃতের বিশেষ লক্ষণ নয়। অশোকের অনুশাসন এবং অর্ধ-মাগধতেও এই লক্ষণ দেখা যায়। ভরত মুনি তার নাট্যশাস্ত্রে বলেন
যে, প্রয়াগ হতে সমুদ্র পর্যন্ত সমস্ত প্রাকৃতে কর্তায় এ-কার হয়।
গঙ্গা-সাগর
মধ্যে তু যে দেশাঃ সংপ্রকীর্তিতাঃ ।
একারবহুলাং তেষু ভাষাং তজজ্ঞঃ
প্রযোজয়েৎ।।(১৭/১৮)
সকর্মক ক্রিয়ার কর্তায় এ –কার
আসামী ভাষায় তনত্য দেখা যায়। কিন্তু অকর্মক ক্রিয়ায় কর্তার বিভক্তি লোপ পায়। যেমন-
“রামে বোলে” (সকর্মক) কিন্তু “রাম হল” (অকর্মক)। পূর্ববঙ্গের কোন কোন উপভাষাতেও এ প্রয়োগ
দেখা যায়। এ থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে এসব স্থলে কর্তায় এ-কার করণ কারকের এ-কার
হতে এসেছে। যেমন- সাদৃশ্য দ্বারা “রামে দেখল” থেকে ”রামে দেখে” এসেছে। সংস্কৃততে এটি
“রামেণ দৃষ্টম” এবং ”রামঃ পশ্যতি”।
“মড়া” শব্দটি মাগধী প্রাকৃত
ছাড়াও অন্য প্রাকৃতে থাকতে পারে। সংস্কৃততে কৃত, গত স্থানে মাগধীতে কড়, গড় হয় কিন্তু
বাংলায় এমন হয় না।
মাগধী প্রাকৃতের ধ্বনিতত্ত্বর
আরেকটি লক্ষণ সংস্কৃতের বর্গীয় জ স্থলে য় হয়। অন্যান্য প্রাকৃতে জ্জ কিন্তু মাগধীতে
য়্য় হয়। যেমন-
সংস্কৃত মাগধী বাংলা
জল য়ল জল
সংস্কৃত মহারাষ্ট্রী মাগধী বাংলা
কার্য কজ্জ কয়্য় কাজ
অদ্য অজ্জ অয়্য আজ
সুতরাং এগুলো মাগধী প্রাকৃত
থেকে আসতে পারে না। ”মড়া” শব্দটিকে তিনি মাগধী প্রাকৃত থেকে কৃতঋণ (ধার করা) শব্দ বলে
মনে করেন।
৩য়
মতবাদ: বাংলা ভাষা গৌড়ী প্রাকৃত থেকে উৎপন্ন হয়েছে
এই মতবাদের প্রবক্তা ড. মুহম্মদ
শহীদুল্লাহ। তিনি তার লেখা ”বাঙ্গালা ভাষার ইতবৃত্ত” বইটিতে এই মতের পক্ষে তার যুক্তিগুলো
উপস্থাপন করেন।
তার মতে যদিও গৌড়ী প্রাকৃতের
কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি কিন্তু আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে দণ্ডী তার কাব্যাদর্শে
এর উল্লেখ করেছিলেন এভাবে-
”শৌরসেনী চ গৌড়ী চ লাটী
চান্যাচ তাদৃশী ।
যাতি প্রবৃতমিত্যেবং ব্যবহারেষু সন্নিধিম।”
(৯।৩৫)
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তুলনামূলক
ভাষাতত্ত্বের সাহায্যে এর বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করেছেন।
১। এতে পৈশাচী প্রাকৃতের ন্যায়
ণ ন স্থানে হবে।
২। শব্দের আদিতে বর্গীয় এবং
অন্তঃস্থ ব বর্গীয় ছিল।
৩। এতে মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতের
ন্যায় আদি য় স্থানে জ এবং মধ্য বা অন্ত্যের দ্য, র্জ, র্য্য প্রভৃতি স্থলে জ্জ হত।
৪। র বর্ণের প্রায় পরিবর্তন
হত না।
৫। সম্ভবত এতে মহারাষ্ট্রী
প্রাকৃতের ন্যায় শ, ষ স্থলে স ছিল।
গৌড়ী প্রাকৃতের পরবর্তী স্তর
গৌড় অপভ্রংশ। প্রাকৃত বৈয়াকরণে মার্কণ্ডেয় ২৭টি অপভ্রংশের মধ্যে গৌড় অপভ্রংশের নাম
উল্লেখ করেছেন। কাহ্নের ও সরহের দোহাকোষে এবং প্রাকৃত পিঙ্গলে অপভ্রংশের কিছু নিদর্শন
পাওয়া যায়। এর বৈশিষ্ট্যগৈুলি উল্লেখ করে তিনি তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের সাহায্যে এর
রূপ নির্ণয় করে উদাহরণ দিয়েছেন।
১। সাধারণত কর্তা ও কর্মে বিভক্তি
লোপ হত। যেমন- বুদ্ধ ঘোড়অ দেক্খই ( বুদ্ধ ঘোড়া দেখে)।
২। নামযুক্ত বাক্যে কর্তায়
ও বিধেয় বিশেষণে কখনও কখনও অকারান্ত শব্দে একার যোগ হত। যেমন-এহু গচ্ছে বড্ডে ( এই
গাছ বড়)।
৩। সম্বন্ধ পদ বিশেষণের ন্যায়
সম্বন্ধীয় বিশেষ্যের লিঙ্গভাগী হত। যেমন- রামকেরী বাড়িত্ত বহুত্ত গচ্ছানি আচ্ছন্তি
( রামের বাড়ীতে বহুত গাছ আছে)।
৪। সকর্মক ুক্রয়ার অতীত এবং
ভবিষ্যৎ কালে ক্রিয়া কর্মের লিঙ্গভাগী হত। যেমন- মইঁ তেন্তিলী খাইল্লী ( আমি তেতুঁল
খাইলাম), মইঁ দিব্বি পিরিচ্ছা ( আমি পৃচ্ছা দেব)।
৫। অকর্মক ক্রিয়ার অতীত ও ভবিষ্যৎ
কালে ক্রিয়া কর্তার লিঙ্গ অনুসরণ করত। করণে এঁ, সম্বন্ধে কর এবং ক, সম্প্রদানে ক, অপাদানে
হু এবং অধিকরণে এ, ত্ত, হি, ভিবক্তি হত। অতীত কালে ইল্ল এবং ভবিষ্যৎ কালে ইব্ব প্রত্যয়
যুক্ত হত। যেমন- বগহনী ঘরে গইল্লী ( বোন ঘরে গেল) ।
এই গৌড় অপভ্রংশ থেকেই বাংলা
ভাষার উৎপত্তি বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন