রবীন্দ্র সাহিত্যে মানবতা
রবীন্দ্রনাথ মানবতার কবি। “মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।” এই বিশ্বাস ছিল তার অঁটুট। তাই তিনি কখনও মানুষের উপর থেকে তার আস্থা হারাননি।
মানুষের ওপর প্রগাঢ় বিশ্বাস ও আস্থা রবীন্দ্রসাহিত্যর মূল ভিত্তি। তাই রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় ও লেখায় মানবতাবাদী ভাব-ধারার উজ্জ্বল প্রকাশ লক্ষ করা যায়। তিনি বলেছেন “প্রাণ” কবিতায়-
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
জীবনবাদী রবীন্দ্রনাথ এভাবেই বার বার পরকাল নয় ইহকালে মানুষেকে ভালবেসে মানুষের মধ্যে থাকতে চেয়েছেন।
আধুনিককালে মানবতা বলতে আমরা বুঝি মানুষের মর্যাদাকে সবার উপরে স্থান দেয়া, মানুষের কল্যাণ, তার সার্বিক বিকাশ, মানুষের সামাজিক জীবনের উপযোগী অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব আরোপ। ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে মানুষের ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে স্বীকার করা, মানুষের ইহজাগতিক প্রয়োজনীয়তা ও আকাঙ্ক্ষা মেটানোর জন্য মানুষের অধিকারকে সমর্থন, ধর্মের চোখে নয়, মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, যুক্তি দিয়ে সব কিছু বিচার-বিশ্লেষ।
অবশ্য এই মানবতার কথা আমাদের বৈষ্ণব কবিরা (চণ্ডীদাস) মধ্যযুগেই বলে গেছেন-“সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।”
রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বর ও মানুষ দুই-ই বিশ্বাস করতেন। কিন্তু দেবতা বা ঈশ্বর মানুষকে রক্ষা করে এ তিনি মানেননি। তাঁর মতে, মানুষই নিজের চিন্তা, কর্ম ও জ্ঞানের শক্তি কাজে লাগিয়ে নিজেকে রক্ষা করেছে এবং করছে। ভিক্ষুকের মত কারও সাহায্য প্রার্থী নয় আত্মশক্তিতে বলীয়ান মানুষ তিনি চেয়েছেন। তাই তিনি গীতাঞ্জলিতে বলছেন-
“বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা-
বিপদে আমি না যেন করি ভায়।
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখ যেন করিতে পারি জয়।”
তার রচনা মানবের জয়গানে মুখর। মানব জীবনের সব বদ্ধ দুয়ার ভেঙে ফেলার প্রেরণা সেখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
ছোটগল্পেও তার এই মানবতাবাদী ভাবনার আশ্চর্য প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।
‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবিক চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। এতে বৃহত্তর মানবতার সুর ধ্বনিত। এই গল্পে মানুষের স্নেহ-মমতাকে সর্বজনীনতামণ্ডিত করে তিনি দেখিয়েছেন, মানবতার মৌল সম্পর্কের ক্ষেত্রটি জাতিধর্ম ও দেশ-কালের ঊর্ধ্বে।
অনেকগুলো গল্পে রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী ভাবনা মূর্ত হয়ে উঠেছে সমাজ জীবনে মানুষের অধিকার, স্বাভাবিক জীবনের বিকাশ ও অস্তিত্বের সংকটকে কেন্দ্র করে। যেমন বরপণ প্রথার হৃদয়হীনতার ছবি ফুটে উঠেছে ‘দেনা-পাওনা’, ‘ঠাকুরদা’, ‘পণরক্ষা’, ‘হৈমন্তী’, ‘অপরাজিতা’ ইত্যাদি গল্পে।
সামাজিক বিবেচনাহীনতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়ার পরিচয় রয়েছে ‘বিচারক’ গল্পে। যে পুরুষ নারীত্বের মহিমাকে ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছে তাকে বিচারকের আসনে বসিয়ে বিবেকহীন সমাজের বিরুদ্ধে ও মানবিকতার পক্ষে রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদমুখর হয়েছেন এই গল্পে।
তার ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে ইংরেজদের আমলাতন্ত্রের নিষ্ঠুর বর্বরতাকে চূড়ান্ত ধিক্কারে জর্জরিত করা হয়েছে। ইংরেজ শাসক, মালিক-ম্যানেজার ও বিচারকের জুলুম, আইনের প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা, শাসিত জাতির প্রতি জুলুম ও দম্ভ ইত্যাদির বাস্তব ছবি ফুটে উঠেছে। সেই সঙ্গে জমিদার-নায়েবদের বিরুদ্ধে তিনি ধিক্কার জানিয়েছেন।
জাতিভেদ, বর্ণভেদ, ধর্মহীনতা সব ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ সবার উপরে মানুষের মহিমাকেই বড় করে দেখিয়েছেন। তাই ‘রবিবার’ গল্পের অভীককে দিয়ে তিনি বলিয়েছেন : ‘যে দেশে দিনরাত্রি ধর্ম নিয়ে খুনোখুনি সে দেশে সর্ব ধর্মকে মেলাবার পুণ্যব্রত আমার মতো নাস্তিকেরই।’
‘ল্যাবরেটরি’ গল্পের নন্দকিশোর সামাজিক অর্থে ধর্মকে স্বীকার করেনি এবং মোহিনীর মতো নিম্নস্তরের মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী করে বর্ণাশ্রয়ী সমাজের মানসিকতার বিরুদ্ধে মানুষের মহিমাকেই বড় করে দেখিয়েছেন।
‘মুসলমানি গল্পে’ রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর জোর দিয়েছেন। এ ধরনের গল্পে ধর্মনিরপেক্ষ হৃদয়ধর্মের প্রতি তাঁর আজন্ম আকর্ষণ তীব্র ও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের দুর্ভাগা কাদম্বিনীকে মরে প্রমাণ করতে হয়েছে যে সে মরেনি। ‘কঙ্কাল’ গল্পে নারীর রূপ সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্ঠিভঙ্গির স্বরূপ তুলে ধরে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে, তা নারীর মানবিক জীবন-চেতনার পথে প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ।
‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ নারীমুক্তির প্রসঙ্গ টেনেছেন ব্যক্তিত্বসচেতন নারী মৃণালের জবানীতে আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে। মৃণাল সংসারের অন্যায়-অবিচার, হৃদয়হীনতা ও বৈষম্য সইতে না পেরে অবশেষে বিদ্রোহ করেছে। তার বিদ্রোহী নারী হৃদয় হৃদয়হীন সংসারের শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে লাভ করেছে মুক্তির স্বাদ। ‘বদনাম’ গল্পের সৌদামিনীও এমনিভাবে বিদ্রোহী হয়েছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কাব্যে ও প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যেমন মানবতার বাণীকে বাঙ্ময় করে তুলেছেন তেমনি তাঁর ছোটগল্পেও চিত্রিত হয়েছে তার বহুবর্ণিল ছবি।
“গোরা” উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই ভারতীয় হিসেবে গোরার যে আত্ম-অহং বোধ, ফলে ইংরেজদের প্রতি তার ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ কিন্তু উপন্যাসের শেষে দেখি গোরা পরিচয় উন্মোচন হয় গোরা আসলে কোন ব্রিটিশ দম্পতিরই সন্তান।
এভাবে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ মানুষের এই পরিচয় কত মিথ্যা। মানুষের বড় পরিচয় সে মানুষ । এটাই চরম সত্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন