বাঙালির
নৃতাত্ত্বিক পরিচয়
ভূমিকা:
বাঙালিকে
বলা হয় সংকর জাতি। বহুকাল ধরে বহু জাতির সংমিশ্রণে এ জাতির সৃষ্টি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ
বলেছেন-
“কেহ নাহি জানে কার আহবানে কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা
হেথায় আর্য হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড় চীন
শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন”
কবিতায়
বাঙালি জাতির জাতিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য মনে হয় এর চেয়ে ভালভাবে আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে
পারেননি। সুদূর প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন কালে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে নানা জাতি
এসে ভারতবর্ষের মানব স্রোত ধারায় মিশে গেছে। বঙ্গের বাঙালি জাতির ক্ষেত্রেও এই একই
ঘটনা ঘটেছে। পৃথিবীর নানা জাতির রক্ত মিলে মিশে একাকার হয়ে এবং রূপান্তরের নানা স্তর
পার হয়ে বর্তমান বাঙালি জাতির সৃষ্টি হয়েছে। এই রূপান্তর নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে নানা
মতভেদ থাকলেও সেগুলো থেকে আমরা কিছু সাধারণ লক্ষণ তুলে আনতে পারি যা বাঙালি জাতির বৈশিষ্ট্যকে
তুলে ধরে।
নৃ-পরিমাপের ক্ষেত্রে সাধারণত দুটি বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনা করা হয়। বাহ্যিক শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং অভ্যন্তরীন শারীরিক বৈশিষ্ট্য। এছাড়া ভাষাগত উপদান, সংস্কৃতিগত উপাদান এসবও বিবেচনা করা হয়।
বাহ্যিক শারীরিক বৈশিষ্ট্য:
পৃথিবীর
আনুমানিক জনসংখ্যা ৮শ কোটির কাছাকাছি হলেও এটা সত্য যে, চেহারায় কারও সাথে কারও কোন
মিল নেই। কারণটা হচ্ছে জিনগত বৈশিষ্ট্য। আবার এই জিনগত সম্পর্কের কারণেই প্রতিটি জনগোষ্ঠীর
কমন কিছু বৈশিষ্ট্য অন্যদের থেকে আলাদা। স্বাতন্ত্র্যসূচক এই বৈশিষ্ট্যগুলো একটি জাতি
বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিত্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন:
১.
দেহের রং: মানুষের দেহের রং সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে- সাদা কালো এবং পীত বর্ণ বা
তামাটে রং।
২.
চোখের মণির রং: মানুষের চোখের মণির রং তিন ধরনের হয়ে থাকে- কাল, নীল এবং ধুসর বা খয়েরি।
৩.
নাকের আকৃতি: মানুষের নাক মূলত তিন ধরনের হয়ে
থাকে। যেমন- সরু লম্বা নাক যা নাজাল ইনডেক্স অনুযায়ী অনুপাত ৫৫%-৭৭% পর্যন্ত প্রশস্ত
।
মাঝারি
নাক ৭৮%-৮৫ পর্যন্ত প্রশস্ত এবং চওড়া নাক ৮৬%-১০০% পর্যন্ত প্রশস্ত হয়।
৪.
চুলের রং ও বৈশিষ্ট্য: নিগ্রো জনগোষ্ঠীর চুলের রং মূলত কালো হয়। আর বৈশিষ্ট্যের দিক
থেকে কোঁকড়ানো হয়ে থাকে।
মঙ্গোলীয়দের
চুল হয় সোজা বা খাঁড়া এবং চুলের রং হয় হালকা ধূসর থেকে কাল বর্ণের।
ঢেউ
খেলানো চুল পৃথিবীর বাকী জাতিগুলোর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। এদের মধ্যে সোনালি এবং সাদা
চুলের আধিক্য বেশি।
৫.
মাথার খুলির আকার বা গঠন: গঠন অনুসারে মানুষের মাথাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। মাপ অনুযায়ী
৭৫ শতাংশ পর্যন্তকে অনুপাতকে লম্বা আকৃতির মাথা হিসেবে ধরা হয়। মাপ ৭৬- ৮০ শতাংশ হলে
মাঝারি আকৃতির এবং ৮০ এর অধিক হলে তাকে বিস্তৃত বা গোল আকৃতির মাথা বলা হয়।
৬.
দেহের উচ্চতা: ১৪৮০ মিমি এর কম উচ্চতাকে ধরা হয় বামন আকৃতি হিসেবে। ১৪৮১ – ১৫৮১ মিমি
হলে বেঁটে, ১৫৮২-১৬৭৬ মিমি হলে মাঝারি, ১৬৭৭-১৭২০ মিমি হলে লম্বা এবং ১৭২১ এর উপরের
উচ্চতাকে খুব লম্বা দৈর্ঘ্য সম্পন্ন হিসেবে ধরা হয়।
৭.
মুখের আকৃতি বা চোয়ালের হাড়ের গঠন: মানুষের চোয়ালের হাড় বা মুখের আকৃতি জাতিসূচক বৈশিষ্ট্যগুলোকে
ধারণ করে। যেমন- নিগ্রোদের চোয়ালের হাড় এবং মুখের আকৃতি সাধারণত লম্বা হয় আবার মঙ্গোলীয়দের
মুখের আকৃতি গোলাকার এবং চোয়ালের হাঁড় উঁচু হয়।
শরীরের অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে রক্তের বিভাগ। আমরা রক্তের চারটি বিভাগের কথা জানি-এ, বি, এবি এবং ও। এই গ্রুপগুলোর মধ্যে বিভিন্ন উপাদান তাদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে।
বাঙালির নৃ-তত্ত্ব:
বাংলার
আদিম অধিবাসী ছিল আদি অস্ত্রালরা (Proto-Australoid)
অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সাথে তাদের দৈহিক গঠন এবং রক্তের মিল আছে বলে এদের আদি-অস্ট্রাল বলা হয়। ভারতের প্রাক দ্রাবিড় অর্থাৎ আদি-অস্ত্রাল এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের রক্তে (A- Agglutinogen) এ-এগ্লুটিনোজেনের শতকরা হার খুব বেশি। আদি-অস্ট্রালদের গায়ের রং কালো, চুল ঢেউ খেলানো, নাক চ্যাপ্টা ও চওড়া, মাথার খুলি লম্বা থেকে মাঝারি এবং দেহ খর্বাকৃতি। এই আদি-অস্ট্রালদের একটি শাখাই ভারতবর্ষ ত্যাগ করে সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিল। বাংলাদেশ-ভারতে বর্তমানে এদের প্রকৃত প্রতিনিধি হচ্ছে সাওঁতাল-মুণ্ডা এসব জনগোষ্ঠী।
বাংলার আদি-অস্ট্রালদের সাথে দ্রাবিড়দের রক্ত মিশে গিয়েছিল আলপাইনরা আসার আগে। আলপাইনদের মত দ্রাবিড়রাও ভারতবর্ষে আগন্তুক। নৃতাত্ত্বিক ভাষায় দ্রাবিড়দের বলা হয় ভূমধ্য বা মেডিটারিয়ান গোষ্ঠীভুক্ত। তাদের সাথে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের জাতি সমূহের মিল পাওয়া যায়। তাদের উচ্চতা মাঝারি, মাথা লম্বা, পাতলা গড়ন, মধ্যম নাসিকা ও দেহের রং হালকা বাদামী থেকে গাঢ় বাদামী, কাল চুল ও চোখ। আদি-মিশরীয়দের সাথে দ্রাবিড়দের মিল সবচেয়ে বেশি।
আদি-অস্ট্রাল এবং দ্রাবিড়রা ভিন্ন ভাষায় কথা বলত। আদি-অস্ট্রালদের ভাষাকে বলা হয় অস্ট্রিক ভাষা। অস্ট্রিক ভাষার প্রভাব বাংলা ভাষায় প্রবল দেখা যায়। বর্তমান কালের সাঁওতাল, মুণ্ডারি ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর ভাষা হচ্ছে অস্ট্রিক ভাষা এবং এরাই হচ্ছে বাংলার প্রাক-দ্রাবিড় যুগের আদি-অস্ট্রাল জনগোষ্ঠী।
বৈদিক
আর্যদের আগমনের অব্যবহিত পরে আলপাইন পর্যায়ভূক্ত লোকেদের আগমন বলে মনে করা হয়। রমাপ্রসাদ
চন্দ্র এদের আদি জাতিরূপকে বলেছেন ‘হোমো-আলপিনাস’। এদের আরেকটি নাম ইন্দো-ভূমধ্য গোষ্ঠী।
তারা পশ্চিম ইউরোপের বিস্তৃতশিরস্ক বিশিষ্ট লোকেদের মত ইটালো-সেলটিক ভাষার অনুরূপ এক
আর্য ভাষায় কথা বলত এবং একই ধরনের বিস্তৃতশিরস্ক বলে তাদের আলপাইন গোষ্ঠী বলা হয়। তাদের
গায়ের রং ছিল গোলাপী আভা বিশিষ্ট গৌড় বর্ণ কিন্তু সামান্য বাদামী, দেহের দৈর্ঘ্য গড়
উচ্চতার চেয়ে বেশি, উন্নত দীর্ঘ থেকে সরল নাক, লম্বা ডিম্বাকৃতি মুখমণ্ডল, বাদামী রঙের
ঘন ঢেউ খেলান চুল এবং মধ্যম শ্রেণির এবং কাল চোখ এদের বৈশিষ্ট্য।
তারা মূলত কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী অঞ্চল থেকে চৈনিক তুর্কিস্থান তথা চীন সীমান্ত অর্থাৎ দক্ষিণ ইউরেশিয় (এশিয়া মাইনর) অঞ্চলে বসবাস করত। অনেকে মনে করেন ভারতে এসে তারা আর্যাবর্তের দেশগুলো বৈদিক আর্যদের অধিকৃত দেখে পশ্চিম উপকূল ধরে নেমে এসে মধ্য ভারতের মালভূমির ভিতর দিয়ে গঙ্গা নদীর নিম্ন উপত্যকায় গিয়ে বসবাস শুরু করে। অনেকে মনে করেন তারা দ্রাবিড়দের অনুসরণে সমুদ্রপথে আর্যদের পূর্বেই ভারতে এসে পৌঁছ ছিল। তাদের একটি দল পূর্ব উপকূল দিয়ে উড়িষ্যা এবং বাঙলায় বসতি স্থাপন করে। অন্যদলটি ভারতের গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রে দেখা যায়। এরাই বাঙালী ব্রাহ্মণ, কায়স্থ শ্রেণির পূর্বপুরুষ। কিছু অংশ বাঙলার আদিতম অধিবাসী অস্ট্রালদের সাথে দ্রাবিড় রক্ত মিশে গিয়ে যে জনগোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছিল তার সাথে মিশে গিয়ে বাঙালী জাতির নিম্ন বর্গটির সৃষ্টি করেছে।
আলপাইন জনগোষ্ঠীর লোকেরা আর্য ভাষী হলেও ভারতের পঞ্চনদের উপত্যকায় বসতি স্থাপনকারী বৈদিক আর্যদের সাথে তাদের ভাষার কিছু পার্থক্য ছিল। আর্যরা ভারতে প্রবেশ করেছিল ইরান অতিক্রম করে আফগানিস্তানের হয়ে ভারতবর্ষের উত্তর এবং পশ্চিম দিক থেকে। বর্তমান পাকিস্তান এবং কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে। তারা আরও দক্ষিণদিকে অগ্রসর হতে চাইলেও বর্তমান ভারতের র্পশ্চিম দিক থেকে উত্তর দিকে আড়াআড়িভাবে বিস্তৃত বিন্ধ্য পর্বতমালা অতিক্রম করতে না পারায় তাদের অগ্রযাত্রা থেমে যায়। এই আর্যদের বলা হয় নর্ডিক জনগোষ্ঠী বা বৈদিক আর্য। ফলে বাঙালীর মধ্যে বৈদিক আর্য বৈশিষ্ট্য কম দেখা যায়।
এছাড়াও বাঙালীর মধ্যে দীর্ঘশিরস্ক মঙ্গোলীয় উপাদান খুব কমই দেখা যায়। স্যার হার্বাট রিজলি মনে করেছিলেন বাঙালি জাতি গঠনে মঙ্গোলীয়দের ব্যাপক অবদান রয়েছে। কিন্তু বর্তমান কালে সকলে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, তার এই ধারনা সত্য নয়। যদিও মঙ্গোলীয় উপাদানের অনুপাত বাঙালির রক্তে কি পরিমাণ বিদ্যমান তা নিয়ে পরিপূর্ণ বা আলাদা কোন গবেষণা এ যাবত পরিচালিত হয়নি। কিন্তু একটি জাতির দৃশ্যমান যে দৈহিক জনবৈশিষ্ট্য থাকে মঙ্গোলীয় সেই বৈশিষ্ট্যগুলি বাঙালির মধ্যে দেখা যায় না বললেই চলে।
লেখক
অজয় রায় তার “আদি বাঙালি: নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (১৯৯৭)” গ্রন্থে বাঙালির
মূল নৃগোষ্ঠীক যে উপাদানগুলো উল্লেখ করেছেন তা নিম্নরূপ-
১।
বাঙালি মুসলমান-
ক) অস্ট্রেলয়েড উপাদান- ১৭%
খ) দ্রাবিড় উপাদান- ২৯%
গ) হোমো-আলপিনাস বা ব্র্যাকিড উপাদান- ৫১%
ঘ) ইন্দো-আর্য উপাদান- ০৪%
২। বাঙালি হিন্দু-
ক) অস্ট্রেলয়েড উপাদান- ১০%
খ) দ্রাবিড় উপাদান- ২৬%
গ) হোমো-আলপিনাস বা ব্র্যাকিড উপাদান- ৫২%
ঘ) ইন্দো-আর্য উপাদান- ১২%
এই তথ্য থেকে বুঝা যায় যে বাঙালি জন গঠনে
হোমো-আলপিনাস বা ব্র্যাকিড অর্থাৎ ইন্দো-ভূমধ্য নৃগোষ্ঠীর উপাদান মুখ্য ভূমিকা পালন
করেছে। এক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমান এবং বাঙালি হিন্দুর মধ্যে আলাদা নৃগোষ্ঠী সূচক সুস্পষ্ট
পার্থক্য বের করা অত্যন্ত কঠিন।
তবে কোন নৃগোষ্ঠীরূপ সনাক্তকরণে শুধু
নৃ-পরিমাপ বিদ্যা নয় ভাষাও একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। উপমহাদেশে প্রচলিত চারটি
প্রধান ভাষাগোষ্ঠী যেমন- ইন্দো-আর্য, দ্রাবিড়, অস্ট্রো-এশিয়াটিক এবং তিবেটো-বর্মান।
এর মধ্যে বাংলা ইন্দো-আর্য গোষ্ঠীভূক্ত ভাষা। দ্রাবিড় ভাষার কিছু নমূনা বাংলায় পাওয়া
গেলেও তিবেটো-বর্মান প্রভাব অনেক বেশি ক্ষীণ। সেই তুলনায় অস্ট্রো-এশিয়াটিক উপাদান অনেক
বেশি।
এছাড়া গ্রীয়ারসনের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে, বাংলা অন্যান্য আর্য ভাষার চেয়ে গুজরাটি এবং মারাঠী ভাষার অনেক কাছাকাছি। শুধু ভাষার ক্ষেত্রে নয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও অতীতের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকার দেখিয়েছেন যে, অতীতের গুজরাটি ব্রাহ্মণরা যেসব পদবী ব্যবহার করত, যেমন- দত্ত, গুপ্ত, নন্দ, ঘোষ, শর্মা, দাস, মিত্র, দেব, নাগ এসব পদবী বাঙালি হিন্দুরা এখনও ব্যবহার করে।
সুতরাং আমরা অনুমান করতে পারি যে, বাঙালি
হিন্দু কিংবা মুসলমান নির্বিশেষে জাতি সৃষ্টিতে আর্য ভাষাগোষ্ঠীর কোন একটি দল সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রত্যক্ষ অবদান রেখেছে। তাদের মধ্যে দৃশ্যমান নৃগোষ্ঠীগত কোন তফাৎ
নেই। তবে একথা সত্য যে বাঙালির রক্তস্রোতে অস্ট্রিক এবং দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর উপাদান বেশ
ভালভাবে মিশেছে। এতে বৈদিক আর্য এবং মঙ্গোলীয় উপাদান একেবারেই নগন্য।