বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়

 




বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়

 


ভূমিকা:

বাঙালিকে বলা হয় সংকর জাতি। বহুকাল ধরে বহু জাতির সংমিশ্রণে এ জাতির সৃষ্টি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-

“কেহ নাহি জানে কার আহবানে কত মানুষের ধারা

দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা

হেথায় আর্য হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড় চীন

শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন”

কবিতায় বাঙালি জাতির জাতিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য মনে হয় এর চেয়ে ভালভাবে আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। সুদূর প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন কালে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে নানা জাতি এসে ভারতবর্ষের মানব স্রোত ধারায় মিশে গেছে। বঙ্গের বাঙালি জাতির ক্ষেত্রেও এই একই ঘটনা ঘটেছে। পৃথিবীর নানা জাতির রক্ত মিলে মিশে একাকার হয়ে এবং রূপান্তরের নানা স্তর পার হয়ে বর্তমান বাঙালি জাতির সৃষ্টি হয়েছে। এই রূপান্তর নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে নানা মতভেদ থাকলেও সেগুলো থেকে আমরা কিছু সাধারণ লক্ষণ তুলে আনতে পারি যা বাঙালি জাতির বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে।

নৃ-পরিমাপের ক্ষেত্রে সাধারণত দুটি বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনা করা হয়। বাহ্যিক শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং অভ্যন্তরীন শারীরিক বৈশিষ্ট্য। এছাড়া ভাষাগত উপদান, সংস্কৃতিগত উপাদান এসবও বিবেচনা করা হয়। 

বাহ্যিক শারীরিক বৈশিষ্ট্য:

পৃথিবীর আনুমানিক জনসংখ্যা ৮শ কোটির কাছাকাছি হলেও এটা সত্য যে, চেহারায় কারও সাথে কারও কোন মিল নেই। কারণটা হচ্ছে জিনগত বৈশিষ্ট্য। আবার এই জিনগত সম্পর্কের কারণেই প্রতিটি জনগোষ্ঠীর কমন কিছু বৈশিষ্ট্য অন্যদের থেকে আলাদা। স্বাতন্ত্র্যসূচক এই বৈশিষ্ট্যগুলো একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিত্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন:

১. দেহের রং: মানুষের দেহের রং সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে- সাদা কালো এবং পীত বর্ণ বা তামাটে রং।

২. চোখের মণির রং: মানুষের চোখের মণির রং তিন ধরনের হয়ে থাকে- কাল, নীল এবং ধুসর বা খয়েরি।

৩. নাকের আকৃতি:  মানুষের নাক মূলত তিন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন- সরু লম্বা নাক যা নাজাল ইনডেক্স অনুযায়ী অনুপাত ৫৫%-৭৭% পর্যন্ত প্রশস্ত ।

মাঝারি নাক ৭৮%-৮৫ পর্যন্ত প্রশস্ত এবং চওড়া নাক ৮৬%-১০০% পর্যন্ত প্রশস্ত হয়।

৪. চুলের রং ও বৈশিষ্ট্য: নিগ্রো জনগোষ্ঠীর চুলের রং মূলত কালো হয়। আর বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কোঁকড়ানো হয়ে থাকে।

মঙ্গোলীয়দের চুল হয় সোজা বা খাঁড়া এবং চুলের রং হয় হালকা ধূসর থেকে কাল বর্ণের।

ঢেউ খেলানো চুল পৃথিবীর বাকী জাতিগুলোর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। এদের মধ্যে সোনালি এবং সাদা চুলের আধিক্য বেশি।

৫. মাথার খুলির আকার বা গঠন: গঠন অনুসারে মানুষের মাথাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। মাপ অনুযায়ী ৭৫ শতাংশ পর্যন্তকে অনুপাতকে লম্বা আকৃতির মাথা হিসেবে ধরা হয়। মাপ ৭৬- ৮০ শতাংশ হলে মাঝারি আকৃতির এবং ৮০ এর অধিক হলে তাকে বিস্তৃত বা গোল আকৃতির মাথা বলা হয়।

৬. দেহের উচ্চতা: ১৪৮০ মিমি এর কম উচ্চতাকে ধরা হয় বামন আকৃতি হিসেবে। ১৪৮১ – ১৫৮১ মিমি হলে বেঁটে, ১৫৮২-১৬৭৬ মিমি হলে মাঝারি, ১৬৭৭-১৭২০ মিমি হলে লম্বা এবং ১৭২১ এর উপরের উচ্চতাকে খুব লম্বা দৈর্ঘ্য সম্পন্ন হিসেবে ধরা হয়।

৭. মুখের আকৃতি বা চোয়ালের হাড়ের গঠন: মানুষের চোয়ালের হাড় বা মুখের আকৃতি জাতিসূচক বৈশিষ্ট্যগুলোকে ধারণ করে। যেমন- নিগ্রোদের চোয়ালের হাড় এবং মুখের আকৃতি সাধারণত লম্বা হয় আবার মঙ্গোলীয়দের মুখের আকৃতি গোলাকার এবং চোয়ালের হাঁড় উঁচু হয়।

শরীরের অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে রক্তের বিভাগ। আমরা রক্তের চারটি বিভাগের কথা জানি-এ, বি, এবি এবং ও। এই গ্রুপগুলোর মধ্যে বিভিন্ন উপাদান তাদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে।

বাঙালির নৃ-তত্ত্ব:

বাংলার আদিম অধিবাসী ছিল আদি অস্ত্রালরা (Proto-Australoid)

অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সাথে তাদের দৈহিক গঠন এবং রক্তের মিল আছে বলে এদের আদি-অস্ট্রাল বলা হয়। ভারতের প্রাক দ্রাবিড় অর্থাৎ আদি-অস্ত্রাল এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের রক্তে (A- Agglutinogen) এ-এগ্লুটিনোজেনের শতকরা হার খুব বেশি। আদি-অস্ট্রালদের গায়ের রং কালো, চুল ঢেউ খেলানো, নাক চ্যাপ্টা ও চওড়া, মাথার খুলি লম্বা থেকে মাঝারি এবং দেহ খর্বাকৃতি। এই আদি-অস্ট্রালদের একটি শাখাই ভারতবর্ষ ত্যাগ করে সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিল। বাংলাদেশ-ভারতে বর্তমানে এদের প্রকৃত প্রতিনিধি হচ্ছে সাওঁতাল-মুণ্ডা এসব জনগোষ্ঠী।

বাংলার আদি-অস্ট্রালদের সাথে দ্রাবিড়দের রক্ত মিশে গিয়েছিল আলপাইনরা আসার আগে। আলপাইনদের মত দ্রাবিড়রাও ভারতবর্ষে আগন্তুক। নৃতাত্ত্বিক ভাষায় দ্রাবিড়দের বলা হয় ভূমধ্য বা মেডিটারিয়ান গোষ্ঠীভুক্ত। তাদের সাথে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের জাতি সমূহের মিল পাওয়া যায়। তাদের উচ্চতা মাঝারি, মাথা লম্বা, পাতলা গড়ন, মধ্যম নাসিকা ও দেহের রং হালকা বাদামী থেকে গাঢ় বাদামী, কাল চুল ও চোখ।  আদি-মিশরীয়দের সাথে দ্রাবিড়দের মিল সবচেয়ে বেশি।

আদি-অস্ট্রাল এবং দ্রাবিড়রা ভিন্ন ভাষায় কথা বলত। আদি-অস্ট্রালদের ভাষাকে বলা হয় অস্ট্রিক ভাষা। অস্ট্রিক ভাষার প্রভাব বাংলা ভাষায় প্রবল দেখা যায়। বর্তমান কালের সাঁওতাল, মুণ্ডারি ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর ভাষা হচ্ছে অস্ট্রিক ভাষা এবং এরাই হচ্ছে বাংলার প্রাক-দ্রাবিড় যুগের আদি-অস্ট্রাল জনগোষ্ঠী।

বৈদিক আর্যদের আগমনের অব্যবহিত পরে আলপাইন পর্যায়ভূক্ত লোকেদের আগমন বলে মনে করা হয়। রমাপ্রসাদ চন্দ্র এদের আদি জাতিরূপকে বলেছেন ‘হোমো-আলপিনাস’। এদের আরেকটি নাম ইন্দো-ভূমধ্য গোষ্ঠী। তারা পশ্চিম ইউরোপের বিস্তৃতশিরস্ক বিশিষ্ট লোকেদের মত ইটালো-সেলটিক ভাষার অনুরূপ এক আর্য ভাষায় কথা বলত এবং একই ধরনের বিস্তৃতশিরস্ক বলে তাদের আলপাইন গোষ্ঠী বলা হয়। তাদের গায়ের রং ছিল গোলাপী আভা বিশিষ্ট গৌড় বর্ণ কিন্তু সামান্য বাদামী, দেহের দৈর্ঘ্য গড় উচ্চতার চেয়ে বেশি, উন্নত দীর্ঘ থেকে সরল নাক, লম্বা ডিম্বাকৃতি মুখমণ্ডল, বাদামী রঙের ঘন ঢেউ খেলান চুল এবং মধ্যম শ্রেণির এবং কাল চোখ এদের বৈশিষ্ট্য।

তারা মূলত কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী অঞ্চল থেকে চৈনিক তুর্কিস্থান তথা চীন সীমান্ত অর্থাৎ দক্ষিণ ইউরেশিয় (এশিয়া মাইনর) অঞ্চলে বসবাস করত। অনেকে মনে করেন ভারতে এসে তারা আর্যাবর্তের দেশগুলো বৈদিক আর্যদের অধিকৃত দেখে পশ্চিম উপকূল ধরে নেমে এসে মধ্য ভারতের মালভূমির ভিতর দিয়ে গঙ্গা নদীর নিম্ন উপত্যকায় গিয়ে বসবাস শুরু করে। অনেকে মনে করেন তারা দ্রাবিড়দের অনুসরণে সমুদ্রপথে আর্যদের পূর্বেই ভারতে এসে পৌঁছ ছিল। তাদের একটি দল পূর্ব উপকূল দিয়ে উড়িষ্যা এবং বাঙলায় বসতি স্থাপন করে। অন্যদলটি ভারতের গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রে দেখা যায়। এরাই বাঙালী ব্রাহ্মণ, কায়স্থ শ্রেণির পূর্বপুরুষ। কিছু অংশ বাঙলার আদিতম অধিবাসী অস্ট্রালদের সাথে দ্রাবিড় রক্ত মিশে গিয়ে যে জনগোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছিল তার সাথে মিশে গিয়ে বাঙালী জাতির নিম্ন বর্গটির সৃষ্টি করেছে।

আলপাইন জনগোষ্ঠীর লোকেরা আর্য ভাষী হলেও ভারতের পঞ্চনদের উপত্যকায় বসতি স্থাপনকারী বৈদিক আর্যদের সাথে তাদের ভাষার কিছু পার্থক্য ছিল। আর্যরা ভারতে প্রবেশ করেছিল ইরান অতিক্রম করে আফগানিস্তানের হয়ে ভারতবর্ষের উত্তর এবং পশ্চিম দিক থেকে। বর্তমান পাকিস্তান এবং কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে। তারা আরও দক্ষিণদিকে অগ্রসর হতে চাইলেও বর্তমান ভারতের র্পশ্চিম দিক থেকে উত্তর দিকে আড়াআড়িভাবে বিস্তৃত বিন্ধ্য পর্বতমালা অতিক্রম করতে না পারায় তাদের অগ্রযাত্রা থেমে যায়। এই আর্যদের বলা হয় নর্ডিক জনগোষ্ঠী বা বৈদিক আর্য। ফলে বাঙালীর মধ্যে বৈদিক আর্য বৈশিষ্ট্য কম দেখা যায়। 

এছাড়াও বাঙালীর মধ্যে দীর্ঘশিরস্ক মঙ্গোলীয় উপাদান খুব কমই দেখা যায়। স্যার হার্বাট রিজলি মনে করেছিলেন বাঙালি জাতি গঠনে মঙ্গোলীয়দের ব্যাপক অবদান রয়েছে। কিন্তু বর্তমান কালে সকলে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, তার এই ধারনা সত্য নয়। যদিও মঙ্গোলীয় উপাদানের অনুপাত বাঙালির রক্তে কি পরিমাণ বিদ্যমান তা নিয়ে পরিপূর্ণ বা আলাদা কোন গবেষণা এ যাবত পরিচালিত হয়নি। কিন্তু একটি জাতির দৃশ্যমান যে দৈহিক জনবৈশিষ্ট্য থাকে মঙ্গোলীয় সেই বৈশিষ্ট্যগুলি বাঙালির মধ্যে দেখা যায় না বললেই চলে।

লেখক অজয় রায় তার “আদি বাঙালি: নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (১৯৯৭)” গ্রন্থে বাঙালির মূল নৃগোষ্ঠীক যে উপাদানগুলো উল্লেখ করেছেন তা নিম্নরূপ-

১। বাঙালি মুসলমান-

        ক) অস্ট্রেলয়েড উপাদান- ১৭%

        খ) দ্রাবিড় উপাদান- ২৯%

গ) হোমো-আলপিনাস বা ব্র্যাকিড উপাদান- ৫১%

ঘ) ইন্দো-আর্য উপাদান- ০৪%

২। বাঙালি হিন্দু-

        ক) অস্ট্রেলয়েড উপাদান- ১০%

        খ) দ্রাবিড় উপাদান- ২৬%

গ) হোমো-আলপিনাস বা ব্র্যাকিড উপাদান- ৫২%

ঘ) ইন্দো-আর্য উপাদান- ১২%

এই তথ্য থেকে বুঝা যায় যে বাঙালি জন গঠনে হোমো-আলপিনাস বা ব্র্যাকিড অর্থাৎ ইন্দো-ভূমধ্য নৃগোষ্ঠীর উপাদান মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমান এবং বাঙালি হিন্দুর মধ্যে আলাদা নৃগোষ্ঠী সূচক সুস্পষ্ট পার্থক্য বের করা অত্যন্ত কঠিন।

তবে কোন নৃগোষ্ঠীরূপ সনাক্তকরণে শুধু নৃ-পরিমাপ বিদ্যা নয় ভাষাও একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। উপমহাদেশে প্রচলিত চারটি প্রধান ভাষাগোষ্ঠী যেমন- ইন্দো-আর্য, দ্রাবিড়, অস্ট্রো-এশিয়াটিক এবং তিবেটো-বর্মান। এর মধ্যে বাংলা ইন্দো-আর্য গোষ্ঠীভূক্ত ভাষা। দ্রাবিড় ভাষার কিছু নমূনা বাংলায় পাওয়া গেলেও তিবেটো-বর্মান প্রভাব অনেক বেশি ক্ষীণ। সেই তুলনায় অস্ট্রো-এশিয়াটিক উপাদান অনেক বেশি।

এছাড়া গ্রীয়ারসনের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে, বাংলা অন্যান্য আর্য ভাষার চেয়ে গুজরাটি এবং মারাঠী ভাষার অনেক কাছাকাছি। শুধু ভাষার ক্ষেত্রে নয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও অতীতের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকার দেখিয়েছেন যে, অতীতের গুজরাটি ব্রাহ্মণরা যেসব পদবী ব্যবহার করত, যেমন- দত্ত, গুপ্ত, নন্দ, ঘোষ, শর্মা, দাস, মিত্র, দেব, নাগ এসব পদবী বাঙালি হিন্দুরা এখনও ব্যবহার করে।

সুতরাং আমরা অনুমান করতে পারি যে, বাঙালি হিন্দু কিংবা মুসলমান নির্বিশেষে জাতি সৃষ্টিতে আর্য ভাষাগোষ্ঠীর কোন একটি দল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রত্যক্ষ অবদান রেখেছে। তাদের মধ্যে দৃশ্যমান নৃগোষ্ঠীগত কোন তফাৎ নেই। তবে একথা সত্য যে বাঙালির রক্তস্রোতে অস্ট্রিক এবং দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর উপাদান বেশ ভালভাবে মিশেছে। এতে বৈদিক আর্য এবং মঙ্গোলীয় উপাদান একেবারেই নগন্য।

হীনযান ও মহাযান কী?

 


হীনযান ও মহাযান কী?

 

সিদ্ধার্থ গৌতম তার প্রবর্তিত বৌদ্ধধর্মে স্বর্গ প্রাপ্তি নয়, নির্বাণ লাভকেই চরম ও পরম লক্ষ্য বলে উল্লেখ করেছেন। এই নির্বাণ কী? এক কথায় নির্বাণ হচ্ছে যাবতীয় জাগতিক তৃষ্ণার নির্বাপণ বা ক্ষয় ঘটানো। তৃষ্ণাই সমস্ত দুঃখের মূল কারণ। সুতরাং তৃষ্ণাকে রুদ্ধ করতে পারলে দুঃখের উৎপত্তির মূলোৎপাদন হবে। এভাবে দুঃখ থেকে পরম মুক্তি মিলবে। জন্মান্তর রুদ্ধ হবে। কর্মের আর উৎপত্তি হবে না। সবকিছু শূন্য, স্থির হয়ে যাবে।

নির্বাণ প্রাপ্তির জন্য তিনি নির্দেশ  করেছেন সুনিদিষ্ট পথ বা পন্থার। এই পথ বা পন্থা বা পদ্ধতিকেই বলা হয়েছে যান বা সাধন পদ্ধতি। কিন্তু এই পদ্ধতি বা পথ কী বা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পরে তার শিষ্যমণ্ডলীর মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। বুদ্ধের শিষ্যমণ্ডলী দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। যদিও গৌতম বুদ্ধ এ ধরনের কোন যানের কথা কখনও কোথাও বলেননি। হীনযান এবং মহাযান এই নামকরণগুলো মূলত মহাযানীরাই করেছিলেন। কারণ তারা কেবল নিজেদের কথা চিন্তা না করে সকলকে সাথে নিয়ে মুক্তির কথা বলতেন তাই তারা নিজেদেরকে উত্তম, মহান বা মহৎ  বলতেন। অন্যদিকে হীনযানীরা কেবল নিজের মুক্তির জন্য চেষ্টা করতেন তাই তাদেরকে মহাযানীরা অধম বা হীন বলতেন। ক্ষুদ্র অর্থেও হীন শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আর যান অর্থ গাড়ি বা বাহন।  হীনযানী মতবাদকে থেরবাদ বা স্থবিরবাদও বলা হয়।

বুদ্ধের সময়ে অনেক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বুদ্ধের বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদী মতকে খণ্ডন করতে না পেরে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেও তারা হিন্দু ধর্মের সংস্কার থেকে মুক্ত ছিলেন না। ফলে তারা মনের ভেতরে বুদ্ধের মতবাদের সাথে তাদের পূর্ব সংস্কারের ও চিন্তাধারার সমন্বয় করার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর তারাই বৌদ্ধধর্মের আদর্শ এবং রীতি-নীতি নিয়ে ভিক্ষুসংঘের ভেতরে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ফলে নবীন পন্থী সংস্কারবাদী এবং প্রাচীনপন্থী রক্ষণশীল দুটি দলের উদ্ভব হলো। প্রাচীরপন্থীরা বুদ্ধ প্রবর্তিত কঠোর নিয়ম পালনের পক্ষে। অন্যদিকে নবীন পন্থীরা ধর্মে পরিবর্তন এবং নিয়ম শিথিল করে পালনের পক্ষে।

বাংলাপিডিয়ার মতে- ”মহাযানীরা  বোধিসত্ত্ব মতবাদে বিশ্বাসী। বোধিসত্ত্ব হচ্ছেন তিনি, যিনি বারবার জন্মগ্রহণ করেন এবং অপরের পাপ দুঃখভার গ্রহণ করে তাদের আর্তি দূর করেন। তিনি একা নির্বাণ বা মুক্তি লাভ না করে বরং জগতের সকলের মুক্তির জন্য কাজ করেন এবং প্রত্যেক জীবের মুক্তি অর্জনের পর তিনি পরিনির্বাপিত হন। মহাযানের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে এই বোধিসত্ত্বের আদর্শ অর্জন করা।

অন্যদিকে থেরবাদী বা হীনযানীরা- বুদ্ধের প্রদর্শিত নীতি-আদর্শ অনুসারে নিজের অন্তঃকরণ হতে অবিদ্যা, তৃষ্ণা মোহ ধ্বংস করে শমথ বিদর্শন ভাবনায় (ধ্যান) পূর্ণতা অর্জনপূর্বক নির্বাণ লাভ এবং নির্বাণোত্তর বুদ্ধস্থানে উন্নীত হওয়ার সাধনা করে।”

বুদ্ধ প্রদত্ত মূল উপদেশ বা বাণীগুলো নিয়ে উভয় মতবাদীদের মধ্যে কোন বিরোধ ছিল না। উভয় সম্প্রদায় বুদ্ধবাণীর একই বিনয় ব্যবহার করতো। তাদের আলাদা আলাদা কোন বিনয় পুস্তক ছিল না। মূল তফাৎটা ছিল জীবনকে নির্বাণ লাভের সাধন পদ্ধতি নিয়ে।

হীনযানী বা থেরবাদীরা মনে করতেন সাধনার মূল উদ্দেশ্য নির্বাণ লাভ। আর নির্বাণ লাভ হবে ধ্যান এবং অন্যান্য নৈতিক আচার আচরণের অতি নিষ্ঠাপূর্ণ চর্চা বা সাধনার মাধ্যমে। এখানে সাধককে সাধনা করতে হবে শূন্যতার। যে সাধনাকে পাওয়া যাবে অস্তিত্বকে অনস্তিত্বে বিলুপ্ত করে দেওয়ার মাধ্যমে।

মহাযানীরা মনে করেন হীনযানীদের শূন্যতার সাধনা ধর্মাদর্শ হিসেবে ঠিক নয়। তাদের কাছে নির্বাণ লাভ করার চেয়ে বোধিচিত্তের অধিকার লাভই প্রধান।

ভিক্ষুসংঘের মধ্যে সৃষ্ট এই মতভেদ দূর করার জন্য খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৩ সালে বৈশালীতে ২য় বৌদ্ধ-সংগীতি (সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হলেও মতবেদ দূর না হয়ে স্থবিরবাদ এবং মহাসাংঘিক এই দুই ভাগের সৃষ্টি হয়।

২৪৮ বা ২৫৩ খ্রি:পূর্বাব্দে সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় পাটলিপুত্রে ৩য় বৌদ্ধ-সংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। তাতে স্থবিরবাদই সর্বসম্মতভাবে বুদ্ধবাণী হিসেবে গৃহীত হয় এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের সংঘ থেকে বহিষ্কার করা হয়। অশোক ছিলেন স্থবিরবাদের পক্ষে।

এর প্রায় ৩৫০ বছর পরে ৭৮ খ্রি: কুষান রাজা কনিষ্কের আমলে জলন্ধরে মহাসাংঘিকদের উদ্যোগে ৪র্থ বৌদ্ধ-সংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। এখানেই ত্রিপিটক সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয় এবং হীনযান ও মহাযান পন্থা চুড়ান্তভাবে আলাদা হয়ে যায়।

 

হীনযান ও মহাযানের মধ্যে পার্থক্য:

১। হীনযানীরা বুদ্ধকে একজন মানুষ হিসেবে স্বীকার্ করেন, কোন ঈশ্বর, সৃষ্টিকর্তা বা অবতার হিসেবে নয়। বুদ্ধ তাদের কাছে একজন অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী পথপ্রদর্শক, শিক্ষক। হীনযানীরা বুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন বা প্রতীককে পবিত্র মনে করেন।  

মহাযানপন্থীরা বুদ্ধকে একজন অবতার রূপে কল্পনা করেন। যিনি পাপী-তাপীর ত্রাণকর্তা বা ঈশ্বর। সাধারণ মানুষ ঈশ্বরের পূজা করার মত বুদ্ধেরও পূজা করতে পারে, তার কাছে করুণা এবং সাহায্য প্রার্থী হতে পারে। বৌদ্ধধর্মে বুদ্ধমূর্তি পূজার প্রচলন ঘটিয়েছেন মূলত মহাযানীরা। ভবিষ্যতে আর্যমিত্র বুদ্ধের আগমনের প্রবক্তাও তারা। কারণ তারা বিশ্বাস করেন বুদ্ধ নির্বাণ লাভ করলেও তিনি আমাদের মধ্যে আছেন এবং প্রয়োজনে মানুষের কল্যাণে আবার পৃথিবীতে অবতীর্ণ হবেন।

২। হীনযানীরা বুদ্ধের বুদ্ধত্ব লাভের পরবর্তী জীবন এবং তার মুখনিঃসৃত বাণীকে অনুসরণ করার পক্ষপাতী। তাদের মতে কেউ কাউকে মুক্তি দিতে পারে না। বুদ্ধ প্রদর্শিত পথেই সবাইকে মুক্তি লাভ করতে হয়।

মহাযানীদের লক্ষ্য সর্বসাধারণের মুক্তি। তারা বুদ্ধের বোধিসত্ত্ব অর্থাৎ বুদ্ধত্ব লাভের আগের জীবন অনুসরণ করার পক্ষপাতী। বুদ্ধবাণী নয় বুদ্ধের বুদ্ধত্ব লাভের আগের জীবন তাদের কাছে আদর্শ। বুদ্ধ যেমন জন্মে জন্মে পারমী পূর্ণ করে নির্বাণ গমন না করে সমস্ত জীবজগতের প্রতি মৈত্রী প্রদর্শন করে সকলের মুক্তির জন্য ধর্ম প্রচার করেছিলেন, তারপরে নির্বাণ লাভ করেছিলেন, তেমনি মহাযানীরাও জগতের একটি প্রাণীও নির্বাণ লাভ থেকে দূরে থাকলে তারা নির্বাণের জন্য ব্যস্ত হবেন না। অর্থাৎ সবাইকে উদ্ধার করে তারপর নির্বাণে যাবেন। ‍

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- হীনযানীরা বাজার থেকে চাল কিনে রান্নার পক্ষপাতী, অন্যদিকে মহাযানীরা চাষাবাদ করে সেই চাল বের করে সেই চাল দিয়ে রান্নার পক্ষপাতী।

৩। হীনযানীরা নিত্য আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়। পরমাত্মায় তারা বিশ্বাস করে না। তাদের মতে মানুষের চিন্তা, অনুভূতি ইত্যাদি মানসিক ক্রিয়ার প্রবাহকে ব্যবহারিক অর্থে আত্মা বললেও বলা যেতে পারে।

মহাযানীদের মতে ব্যক্তি বা বস্তুর স্বতন্ত্র সত্তা না থাকলেও পরম সত্তা আছে। দৃশ্যমান ব্যক্তিসত্তা পরম সত্তারই বহি:প্রকাশ মাত্র।

৪। হীনযানীদের মতে মানুষ মাত্রই স্বতন্ত্র একটি প্রাণী। লৌকিক জগতে আমরা একে অন্যের আত্মীয় হলেও আধ্যাত্মিক দিক থেকে একে অপরের সাথে আমাদের কারও কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং যার যার কর্মের দায়ভার তার তার। কারও কর্ম বা মুক্তি অন্যের সাথে জড়িত নয়।

মহাযানীদের মতে সমস্ত জীবই এক। সমস্ত প্রাণিজগত এক সূত্রে গ্রথিত। এখানে একক অস্তিত্বের কোন মূল্য নেই। মানুষ একে অপরের সাথে সম্বন্ধযুক্ত এবং নির্ভরশীল।

৫। হীনযানীরা দূরকল্পনা বা অধিবিদ্যাকে মিথ্যা দৃষ্টি বলেছেন। তাই তাদের সাধনায় স্বর্গ-নরক নেই।

মহাযানীরা দূরকল্পনার সাহায্যে স্বর্গ-নরকের অস্তিত্বের কথা বলেছেন। অনেক বোধিসত্ব এবং দেবদেবীর কথা বলেছেন।

৬। হীনযানীরা বুদ্ধবাণীকে প্রামাণ্য হিসেবে গ্রহণ করে অক্ষরে অক্ষরে পালনে বিশ্বাসী। তারা ধর্মের বিশুদ্ধতা রক্ষায় তৎপর। বিনয় বিধানের সামান্য ব্যতিক্রম বা শৈতিল্যও তারা মানতে রাজী নয়।

অন্যদিকে মহাযানীরা বৃহত্তর কল্যাণে ধর্মের পরিবর্তন বা পরিবর্ধনে কুণ্ঠিত নয়। তারা বহু পরবর্তীকালে প্রণীত সূত্রগুলোকেও মান্য বলে মনে নিয়েছেন। তারা ধর্মের উপযোগীতা বাড়াতে তৎপর।

৭। হীনযানীরা ভিক্ষু সংঘকে সম্ভ্রমপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখেন। বুদ্ধের অবর্তমানে ভিক্ষু সংঘকে তারা ধর্মোপদেশ ও আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ প্রদর্শক মনে করেন।

মহাযানীদের মতে বৌদ্ধ ধর্মের নীতি ও বিধানগুলি সকলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং সমানভাবে প্রযোজ্য। তারা সবাই বোধিসত্ত্ব হবার আশায় এবং জগতের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে উৎসর্গীকৃত প্রাণ। প্রয়োজন হলে নিজের জীবন দিয়ে হলেও তারা অপরের কল্যাণ সাধনায় ব্রতী হন। যে কারণে মহযানীরা সমভাবে সংসার ধর্মও পালন করেন।

৮। হীনযানীরা পালি ভাষায় ধর্মের প্রচার করতেন। মহাযানীরা ব্যবহার করতেন সংস্কৃত ভাষা।


গ্রন্থ সহায়তা-

১। চর্যাপদ-অতীন্দ্র মজুমদার

২। বৌদ্ধধর্মে কর্মবাদ বনাম সৃষ্টি-রহস্য- জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়া

৩। উইকিপিডিয়া

৪। বাংলাপিডিয়া

ধ্বনি পরিবর্তনের সূত্র সমূহ: গ্রীমের সূত্র, গ্রাসমানের সূত্র, ভের্নারের সূত্র

 

গ্রীমের সূত্র(Grimm’s Law):

ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষার নিয়মিত ধ্বনি পরিবর্তনের বিষয়টিকে সর্বপ্রথম উল্লেখ করেছিলেন ডেনিস ভাষাবিজ্ঞানী রাসমুস ক্রিস্টিয়ান রাস্ক (Rasmus Kristian Rask) ১৮১৪ সালে ডেনিস একাডেমি অফ সায়েন্সে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন- Undersøgelse om det gamle nordiske eller islandske sprogs oprindelse (An investigation into the origin of the old Norse or Icelandic Language) প্রবন্ধে তিনি প্রাচীন আইসল্যান্ডিয় ভাষার সঙ্গে স্ক্যান্ডিনেভীয় ভাষার এবং জার্মান উপভাষাগুলির কী সম্পর্ক তা দেখিয়েছেন।

এই প্রবন্ধে রাস্ক বলেন, কিছু নির্বাচিত শব্দ নিয়ে সাদৃশ্য ভাষার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করে তাদের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করা বা একই উৎসজাত কিনা যাচাই করা ঠিক হবে না। কারণ ভৌগোলিকভাবে পাশাপাশি অবস্থান করা দুই ভাষার মধ্যে শব্দগত এই সাদৃশ্য শব্দঋণের কারণেও হতে পারে। দুটি ভাষা একে অন্যের কাছ থেকে শব্দ গ্রহণ করে থাকে। এই জন্য দুই ভাষার মধ্যে ব্যাকরণগত সাদৃশ্য কেমন আছে তা দেখতে হবে। কারণ ব্যাকরণগত পরিবর্তন ধীরে সংঘটিত হয়। এই জন্য তিনি রূপতত্ত্বের তুলনার কথা বলেন।

তুলনামূলক পদ্ধতি প্রয়োগে তার মূল কথাটি ছিল, প্রত্যেক ভাষায় কিছু অপরিহার্য শব্দ থাকে। যদি তুলনীয় দুটি ভাষার এইসব শব্দের মধ্যে প্রচুর মিল পরিলক্ষিত হয় এবং অন্য একটি ভাষায় শব্দের কোন ধ্বনি নিয়মিতভাবে (একই নিয়মে/পদ্ধতিতে) পরিবর্তিত হয় তাহলে বলা যাবে দুটি ভাষা একই উৎসজাত এবং তাদের মধ্যে মৌলিক নিকট সম্পর্ক আছে।

রাস্কের এই পর্যবেক্ষণকে প্রথম সূত্রবদ্ধ করেন জ্যাকব গ্রিম (Jacob Grimm) তিনি বিস্তৃত ব্যাখ্যা সহযোগে পরিবর্তনের দিকগুলোর উপর আলোকপাত করেন। গ্রিম ১৮১৯ সালে Deutsche Grammatik নামে জার্মানিক অর্থাৎ টিউটনিক ভাষার উপর একটি ব্যাকরণ লিখেন। এতে গথিক, স্ক্যান্ডিনেভীয়, ইংরেজি, ফ্রিজিয়, ওলন্দাজ জার্মান ভাষার ব্যাকরণের তুলনামূলক আলোচনা করা হয়। ১৮২২ সালে ১ম খণ্ডের ২য় সংস্করণে তিনি Vonden Buchstaben (On the letters) নামে একটি অধ্যায় জুড়ে দেন। যেখানে তিনি ধ্বনি পরিবর্তনের নিয়মকে ব্যাখ্যা করেন। পরিবর্তনটি দুটি পর্যায়ে সংঘটিত হয়। তিনি এর নাম দিয়েছিলেনসাউন্ড শিফট (Sound-Shift)

১ম পর্যায়ে First Sound-Shift মূল ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষা থেকে জার্মানিক বা টিউটনিক শাখাটি পৃথক হয়ে আসার সময় যে ধ্বনি পরিবর্তন ঘটে এখানে তিনি তা ব্যাখ্যা করে দেখান। এই পরিবর্তন আনুমানিক খ্রি:পূ: ৫০০ বছর আগে ঘটে।

২য় পর্যায়ে Second Sound-Shift বা পরিবর্তনটি সংঘটিত হয় ৭ম শতাব্দীতে। জার্মানিক থেকে ওল্ড হাই জার্মান ভাষায়।

গ্রীম ধ্বনি পরিবর্তনের যে নিয়মগুলো উল্লেখ করেছিলেন সেগুলো পরবর্তীতে ভাষাবিজ্ঞানীদের কাছে গ্রীমের সূত্র বলে পরিচিতি লাভ করে। তিনি বলেন এই পরিবর্তন ধ্বনিগত এবং নিয়মমাফিক। এই পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছিল ব্যঞ্জনধ্বনির ক্ষেত্রে। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার প্রতিনিধি হচ্ছে গ্রীক আর জার্মানিক ভাষার প্রতিনিধি হচ্ছে গথিক।

ধ্বনি পরিবর্তনটি তিনটি ধারায় ঘটেছিল।

) মূল ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষার অল্পপ্রাণ অঘোষ স্পৃষ্ট বা স্পর্শ ধ্বনি (un-aspirated voiceless plosive) জার্মানিক ভাষায় মহাপ্রাণ অঘোষ উষ্ম (aspirated voiceless fricative) ধ্বনিতে পরিণত হয়েছে।

গ্রীক(মূল ইন্দো-ইউরোপীয়)   গথিক(জার্মানিক) ১ম ধ্বনি         ২য় ধ্বনি

kardia                                      hairto (foot - পা )           =        

treis                                    threis (three - তিন )             =      

pous                                         fotus (heart - হৃদয় )          =      

) মূল ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষার অল্পপ্রাণ ঘোষ স্পৃষ্ট বা স্পর্শ ধ্বনি(un-aspirated voiced plosive) জার্মানিক ভাষায় অল্পপ্রাণ অঘোষ স্পর্শ (un-aspirated voiceless plosive) ধ্বনিতে পরিণত হয়েছে।

গ্রীক(মূল ইন্দো-ইউরোপীয়)   গথিক(জার্মানিক) ৩য় ধ্বনি      ১ম ধ্বনি

deka                                        taihun               =         

genos                                      kuni                     =         

--               --                =         

) মূল ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষার ঘোষ মহাপ্রাণ স্পৃষ্ট বা স্পর্শ ধ্বনি(voiced aspirated plosive) জার্মানিক ভাষায় ঘোষ অল্পপ্রাণ স্পর্শ (un-aspirated voiced plosive) ধ্বনিতে পরিণত হয়েছে।

গ্রীক(মূল ইন্দো-ইউরোপীয়)   গথিক(জার্মানিক     ৪র্থ ধ্বনি        ৩য় ধ্বনি

chortos                                           gards (yard-উঠান )            =   

thygater                                   dauther (daughter- কন্যা)               =   

phero                                           bairan (bear - ভাল্লুক )          =    

এই পরিবর্তনকে নিচের চিত্রের আকারে দেখান যায়-

 

এখানে চিত্রে-

গ্রীমের পরিভাষা/অভিধা   বর্তমান পরিভাষা/অভিধা

Tenues (, , )      অল্পপ্রাণ অঘোষ স্পৃষ্ট/স্পর্শ ধ্বনি (un-aspirated voiceless plosive)

Mediae (, , )       অল্পপ্রাণ ঘোষ স্পৃষ্ট/স্পর্শ ধ্বনি (un-aspirated voiced plosive)

Aspiratae (, , )     মহাপ্রাণ অঘোষ উষ্ম ধ্বনি (aspirated voiceless fricative)

 

অর্থাৎ মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গ্রীকে যদি T হয় তাহলে জার্মানিকে হবে M ওল্ড হাই জার্মান বা প্রাচীন উচ্চ জার্মানে A হবে এভাবে চক্রাকারে পরিবর্তনটা ঘটে।

চক্রের পরিবর্তনটা এভাবে দেখান হয়-

ইন্দো-ইউরোপীয়-       T                      M                     A

জার্মানিক-       A                     T                      M

প্রাচীন উচ্চ জার্মান-             M                     A                     T

উদাহরণ-

গ্রীক-          phrator             deka                thygater

গথিক-        brother             taithan             daughtar

 উচ্চ প্রাচীন জার্মানে-       brooder            zehan               tother

 

 

Note:

অল্পপ্রাণ ধ্বনি: বর্গের ১ম, ৩য় ধ্বনি ৫ম ধ্বনি

মহাপ্রাণ ধ্বনি: বর্গের ২য় ৪র্থ ধ্বনি

অঘোষ ধ্বনি: বর্গের ১ম ২য় ধ্বনি

ঘোষ ধ্বনি: বর্গের ৩য়, ৪র্থ ৫ম ধ্বনি

স্পর্শ বা স্পৃষ্ট ধ্বনি থেকে পর্যন্ত ধ্বনিগুলো

উষ্ম ধ্বনি: , , , এই চারটি ধ্বনি

জার্মানিক বা টিউটনিক ভাষা: গথিক, স্ক্যান্ডিনেভীয়, ইংরেজি, ফ্রিজিয়, ওলন্দাজ জার্মান ভাষা সমূহ

প্রাচীন উচ্চ জার্মান ভাষা: উচ্চ জার্মান ভাষা হচ্ছে অনেকগুলি সমগোত্রীয় উপভাষার সমষ্টিগত নাম। আদর্শ জার্মান, লুক্সেমবার্গ এবং ইডিশ ভাষার বিভিন্ন রূপ, মধ্য দক্ষিণ জার্মানি, অস্ট্রিয়া, লিশটেনশটাইন, সুইচারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্সের আলজাস লোরেন, ইতালি এবং পোলেন্ডে উচ্চ জার্মান ভাষা প্রচলিত।

উচ্চ বলতে মধ্য দক্ষিণ জার্মানির পার্বত্য অঞ্চল আল্পস পর্বতমালাকে বোঝান হয়। আর নিম্ন জার্মান বলতে উত্তর দিকের সমুদ্র তীরের সমতল ভূমিতে প্রচলিত জার্মান ভাষাকে বোঝান হয়। (সূত্র: উইকিপিডিয়া)

 

গ্রাসমানের সূত্র(Grassmann’s Law):

গ্রীম তার সূত্রের সাহায্যে মূল ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষার সাথে জার্মানিক ভাষার ধ্বনি পরিবর্তনের প্রধান দিকগুলি দেখাতে পারলেও আরও যে ব্যতিক্রম রয়ে গেছে সেগুলো দেখাতে পারেননি। গ্রীমের সূত্রের এই অপূর্ণতা পরবর্তী ভাষা বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন গ্রাসমান।

গ্রীমেন সূত্রানুসারে মূল-ইন্দোইউরোপিয় ভাষার মহাপ্রাণ ঘোষবৎ স্পর্শ ধ্বনি (bh-ভ, dh-ধ, gh-ঘ, gwh-ঘ্ব) শুধু জার্মানিক শাখায় ঘোষবৎ অল্পপ্রাণ স্পর্শ ধ্বনিতে (b-ব, d-দ, g-গ) পরিবর্তিত হবে কিন্তু ইন্দো-ইউরোপিয় অন্যান্য শাখায় অপরিবর্তিত থাকবে। যেমন গথিকে ’ব’ হলে সংস্কৃততে ’ভ’ হওয়ার কথা কিন্তু এমন অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় গথিক এবং সংস্কৃত উভয় ভাষায় ‘ব’ থেকে যায়। যেমন-

গথিক              সংস্কৃত

Buidan            বোধতি

অর্থাৎ সংস্কৃত ‘বোধতি’ স্থলে ‘ভোধতি’ থাকার কথা। এই ব্যতিক্রমটাই গ্রামমান সূত্রাকারে ব্যাখ্যা করেছিলেন। গ্রাসমানের মূল সূত্রটি হল-

মূল ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষায় যেখানে পরপর দুটি মহাপ্রাণ ঘোষধ্বনি (bh, dh, gh, gwh) ছিল সংস্কৃত গ্রীকে দুটি ধ্বনির মধ্যে এবটি পরিবর্তীত হয়ে অল্পপ্রাণ হয়ে যাবে।

মূল ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষায় ভোধতি শব্দে ’ভ’ ও ‘ধ’ পর পর দুটি মহাপ্রাণ ঘোষ ধ্বনি ছিল। সংস্কৃততে একটি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। ‘ভ’ স্থলে ‘ব’ হয়েছে।


ভের্নারের সূত্র (Verner’s Law):

গ্রীমের সূত্রের আরও কিছু ব্যতিক্রম ১৮৭৫ খ্রি: এডলফ কার্ল ভের্নার(Adolf Karl Verner) ব্যাখ্যা করেন। তার নামানুসারেই এই সূত্রটির নাম হয় ভের্নারের সূত্র। গ্রীমের সূত্রানুসারে মূল ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষার যেখানে অল্পপ্রাণ অঘোষ স্পর্শ ধ্বনি জার্মানিক শাখায় মহাপ্রাণ অঘোষ উষ্ম ধ্বনিতে পরিণত হওয়ার কথা আর অন্যান্য শাখায় (গ্রীক, ল্যাটিন, সংস্কৃত) এগুলি অপরিবর্তিত থাকার কথা। সেই অনুসারে মূল ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষায় septm থেকে-

ল্যাটিন             গ্রীক                 সংস্কৃত

Septem           hepta              সপ্ত(sapta)

কিন্তু জার্মানিক শাখার গথিকে হবার কথা ‍sifum (p-প স্থলে f -ফ) কিন্তু গথিকে পাওয়া যাচ্ছে sibum. কার্ল ভের্নার এই ব্যতিক্রমটি ব্যাখ্যা করেন। তার সূত্রটি হল-

গ্রীমের সূত্রানুসারে p-প, t-ত, k-ক, kw-ক্ব পরিবর্তিত হয়ে f, ø, x, xw শুধু যদি এসব ধ্বনির আগে স্বরাঘাত (accent) থাকে। কিন্তু যদি এসব ধ্বনির পরবর্তী অক্ষরে স্বরাঘাত থাকে তবে এসব ধ্বনির অন্যবিধ পরিবর্তন হবে p-প, t-ত, k-ক, kw-ক্ব এবং s তখন হয়ে যাবে b, d, g, gw এবং z . যেমন পরবর্তী উদাহরণ sibum হয়েছে। কারণ মূলশব্দ s-এর পরবর্তী m-এ স্বরাঘাত ছিল। এই কারণে- 

মূল ইন্দো-ইউরোপিয় শব্দ     kmtom

সংস্কৃত             গ্রীক                 ল্যাটিন

শতম              hekaton          centum 

এখানে গ্রীক এবং সংস্কৃতে t অপরিবর্তিত আছে কিন্তু গথিকে hund হয়েছে। অর্থাৎ t পরিবর্তিত হয়ে d হয়েছে।

 --------------------------

সহায়ক গ্রন্থ: 

আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ: আধুনিক ভাষাতত্ত্ব

. উদয় কুমার চক্রবর্তী . নীলিমা চক্রবর্তী: ভাষাতত্ত্ব

: রমেশ^ : সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান বাংলা ভাষা

. সাইফুল্লা অধ্যাপক উদয় কুমার চক্রবর্তী সম্পাদিত : ভাষা বিজ্ঞান সাহিত্যতত্ত্ব

            (নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পাঠক্রম)